07
Nov

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের জেলা কক্সবাজার। সমুদ্রবিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি এই কক্সবাজার। এক পাশে দিগন্তজুড়ে সমুদ্র আর সবুজ পাহাড়ের হাতছানি, অপর পাশে অবকাঠামোগত উন্নয়নযজ্ঞ। কক্সবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভিশনকে উপজীব্য করে ভবিষ্যতের পর্যটন মডেল বিনির্মাণের লক্ষ্যে বর্তমানে একযোগে ৭৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি, যা এক বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে সরকারের মোট বরাদ্দ দেয়া অর্থের দেড় গুণ।

অতীতে কক্সবাজার যেখানে ছিল কেবলই এক সাধারণ দেশীয় পর্যটন কেন্দ্র, সেই জেলাই এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় পর্যটন ও অর্থনীতির এক গেম চেঞ্জার হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। যে কক্সবাজার এতকাল ছিল পর্যটকদের অভিযোগে জর্জরিত, সেই কক্সবাজারই এখন কেবল দেশী নয়, বিদেশী পর্যটকদের কাছেও কাক্সিক্ষত গন্তব্যস্থল। কেবল স্থানীয় অবকাঠামোই নয়, কক্সবাজারের সঙ্গে সমান্তরালে গড়ে উঠছে দেশী, বিদেশী কানেক্টিভিটি। গভীর সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেললাইন, ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ও বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ২৫টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে একযোগে, যা বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে কক্সবাজারের চেহারা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পর্যটনে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে, কক্সবাজার হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র। এই কর্মযজ্ঞ যেন পর্যটন রাজধানীর মানুষের দেখা দীর্ঘদিনের স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন।

প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন রূপরেখা অনুযায়ী, পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সিঙ্গাপুর, হংকংসহ দ্বীপভিত্তিক অর্থনৈতিক হাবগুলোর আদলে গড়ে তুলতে কক্সবাজার ঘিরে এই মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বর্তমান সরকার। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও রেল সংযোগ, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বৈদ্যুতিক হাব গড়ে তোলার কারণে কক্সবাজার এখন দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যটন পার্ক, যা মূলত শুরু হয় ২০০৯ সালে প্রণীত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার ও কুনমিং হয়ে এশিয়ান হাইওয়েতে সম্পৃক্ত হওয়াও সহজ হবে। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৪ ঘণ্টাই বিমান ওঠানামার ব্যবস্থা করতে লোকালাইজার, ভিওআর, জিপি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ স্থাপনের কাজও চলমান রয়েছে। পাশাপাশি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে মহেশখালী ইকোনমিক জোন দ্বীপভিত্তিক বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপ নেবে।

কক্সবাজারের দুর্গম দ্বীপ মাতারবাড়িতে ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতার চারটি বিদ্যুত কেন্দ্র, ল্যান্ডবেজ এলএনজি টার্মিনাল এবং ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন স্থাপনসহ অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল কর্মযজ্ঞ অঞ্চলটিকে ইতোমধ্যেই জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মাতারবাড়িতে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খননযন্ত্র ‘ক্যাসিওপিয়া–ফাইভ’ দিয়ে বালু-মাটি খুঁড়ে লবণমাঠ খনন করে বানানো হয়েছে জাহাজ চলাচলের কৃত্রিম নৌপথ বা চ্যানেল।

এ ছাড়া একই উপজেলায় ১৪৯.৭৫ একর জমি নিয়ে আরেকটি মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন প্রকল্পের কাজ চলছে। বাংলাদেশের প্রধান আমদানিস্থল চীনসহ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যে মেলবন্ধনের নিয়ামক হয়ে উঠবে জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে হতে যাওয়া মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর।

অপর দিকে, দেশে বৃহৎ প্রকল্প মহেশখালী হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা মৌজার আওতায় ১৪১৪.৬৫ একর জমি নিয়ে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। একই উপজেলায় বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড ৮৩২০ মেগাওয়াট এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পও বাস্তবায়ন করবে। বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশাপাশি মহেশখালী ও পেকুয়া উপজেলার ১৩টি মৌজার আওতায় জিটিসিএল সংস্থার মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন প্রকল্প চলমান। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যিক বিনিয়োগ আর পর্যটন শিল্পে কক্সবাজারের অগ্রগতি এখন দৃশ্যমান।

প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত রূপরেখা অনুযায়ী কক্সবাজারে এ ছাড়াও যেসব প্রকল্প সমান্তরালে চলমান, তার মধ্যে রয়েছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোং বাংলাদেশ লিঃ-এর ১২০০ মে.ও. কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণ, মহেশখালী উপজেলাকে ডিজিটাল আইল্যান্ড ঘোষণা বাস্তবায়ন, রামু উপজেলায় হাইটেক পার্ক নির্মাণ, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) স্থাপন, জালিয়ারদ্বীপ স্পেশাল ট্যুরিস্ট জোন স্থাপন, কক্সবাজার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম এবং ক্রিকেট কমপ্লেক্স নির্মাণ, জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন ইত্যাদিসহ আরও বেশকিছু প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা এবং সর্বক্ষণিক নজরদারিতে এসব প্রকল্প কেবল কাগুজে রূপে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং গতিশীল রয়েছে বাস্তবায়নের পথে।

তবে এতসব কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি কিছু অনাকাক্সিক্ষত কর্মকা- শঙ্কার মুখে ফেলে দিচ্ছে কক্সবাজারকে ঘিরে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুফল বয়ে আনাকে। কক্সবাজারকে ঘিরে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কক্সবাজারের যত্রতত্র অপরিকল্পিত স্থাপনা গড়ে তুলছে। এসব অপরিকল্পিত স্থাপনা একদিকে যেমন কক্সবাজারের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের অন্তরায় অন্যদিকে সরকারীভাবে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভারসাম্যও নষ্ট করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য কক্সবাজারের উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সরকারের বিভিন্ন স্থানীয় দফতর অফিসগুলোর কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই এসব অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজারকে ঘিরে সরকারের বিশদ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যেন কোনভাবেই কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিস্বার্থের কাছে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া অতীব জরুরী।

 

শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন

লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

 

Leave A Comment