28
Dec

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এইডস রোগী মুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ চললেও দেশে নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা রকম মরণ ব্যাধি রোগ যার মধ্যে এইডস অন্যতম। বাংলাদেশে আসার পর কক্সবাজার জেলায় চিহ্নিত এইডস রোগীর সংখ্যা বেড়েছে চারগুণেরও বেশি। এর ফলে সারা দেশের মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা বেড়েই চলেছে।

জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইডসের সর্বশেষ তথ্যমতে, মিয়ানমারে জনসংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে এইচআইভি নিয়ে বসবাসকারী মানুষ ২ লাখ ৩০ হাজার। আর দেশটির এইচআইভি বহনকারীর সংখ্যা ০.৮ শতাংশ ৷ সেই হিসাবেও ছয় হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা এইচআইভিতে আক্রান্ত, তা বলা যায়৷

দেশে গত এক বছরে মোট এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়েছে ৬ লাখ ২৮ হাজার ৩১২ জনের। এ ছাড়া ব্লাড স্ক্রিনিং করা হয়েছে আরো ৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৭ জনের। বাংলাদেশে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ০.০১ শতাংশের নিচে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সংক্রমণ কিছুটা বেশি। বর্তমানে, দেশে সম্ভাব্য এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজারের কিছু কম।

গত এক বছরে নতুন আক্রান্ত ৭২৯ জনের মধ্যে রোহিঙ্গা ১৮৮ জন (২৬ শতাংশ), বিদেশফেরত প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্য ১৪৪ জন (২০ শতাংশ), ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৬১ জন (আট শতাংশ), নারী যৌনকর্মী ১৭ জন (দুই শতাংশ), সমকামী ৬৭ জন (৯ শতাংশ), পুরুষ যৌনকর্মী ৫৩ জন (সাত শতাংশ) ও ট্রান্সজেন্ডার ১৩ জন (দুই শতাংশ)।

কক্সবাজার জেলায় এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে গত প্রায় আড়াই বছরে (২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত) মারা গেছেন ৫২ জন। তাঁদের মধ্যে ৩৮ জন বাংলাদেশি ও ১৪ জন রোহিঙ্গা। সর্বশেষ মারা গেছেন ৪৫ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা নারী। তিনি গত বছর মিয়ানমার থেকে এসেছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এইচআইভি অঞ্চল হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলায় ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে থেকেও বাংলাদেশ সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। তবে এই ইস্যুতে নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গারা।

বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ রোহিঙ্গা অভিবাসীরা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি বছর যেভাবে এইডস শনাক্তের হার বাড়ছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। ২০১৭ সালে কক্সবাজার জেলায় এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩২ জন। এরপর রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর এইডস আক্রান্ত রোগীরা সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৮১ জন, যার মধ্যে ৪২৫ জনই রোহিঙ্গা। গত এক বছরে বাংলাদেশে নতুন শনাক্ত ৭২৯ জন এইডস রোগীর মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী ১৮৮ জন।

নতুন রোগীদের একটি বড় অংশ রোহিঙ্গা এবং অভিবাসীকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্য। অনেকের সাথে রোহিঙ্গাদের যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কারণে বর্তমানে ভীষণ ঝুঁকিপুর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জীবিকার তাগিদে রোহিঙ্গা নারীরা কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় যৌন কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন যার দরুন অস্বাভাবিক ভাবে রোগটি ছড়াচ্ছে। স্বামী ও স্ত্রীর মাধ্যমে সন্তানরাও আক্রান্ত হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিজেদের এইডস রোগ আছে জানার পরও তারা কেউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে না। তিনটি সরকারি হাসপাতালে এইডস পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও তেমন রোগীর সংখ্যা নেই। যার দরুন স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাবে এই মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে অস্বাভাবিকভাবে।

বিষয়টি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে কক্সবাজারের সুশীল সমাজ তথা সচেতন সাধারণ মানুষকেও। কক্সবাজার দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা। যেহেতু দেশের সব জায়গা থেকে এখানে পর্যটক আসেন, সেহেতু সারা দেশে এই মারাত্মক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অধিক হারে বাড়ছে। এই সমস্যা মোকাবেলা করতে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে অতি দ্রুত, যার প্রেক্ষিতে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে এইডসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এইডসমুক্ত করার ঘোষণা সরকারের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। যেই চ্যালেঞ্জ উত্তরণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সারা দেশে আক্রান্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং, পজিটিভ লিভিং কাউন্সেলিং, পুষ্টি ও নিরাপদ যৌন উপকরণ বিনামূল্যে বিতরণসহ নানা কর্মসূচির ওপর জোর দেয়া এখন সময়ের দাবী।

 

লেখকঃ শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

Leave A Comment