Deprecated: version_compare(): Passing null to parameter #2 ($version2) of type string is deprecated in /home/sheitefm/public_html/wp-content/plugins/elementor/core/experiments/manager.php on line 132
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দলিল - Sheikh Mohammad Fauzul

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে স্বাধীনতার সিঁড়ির অন্যতম মই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ছয় দফা নামক ঐতিহাসিক সিঁড়ি বেয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। জাতির পিতার ছয় দফায় স্বাধীন বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির যে স্বপ্ন লুক্কায়িত ছিল স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে সেসব স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে আজকের বাংলাদেশ।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন। পরবর্তীতে এই ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপান্তর হতে থাকে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগের ডাকে পূর্ব বাংলায় হরতাল চলাকালে পাকিস্তানী পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালায়। এতে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালী শহীদ হন। প্রায় আট শ’ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী এবং হাজারো আন্দোলনরত সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়।

ছয় দফার গুরুত্বটা অনুধাবন করতে হলে শুরুতেই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে ছয় দফার প্রয়োজন কেন হলো সেই পটভূমি নিয়েও একটু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা আদায়ের সংগ্রাম বাঙালীর মুখের ভাষার অধিকার তো নিশ্চিত করেছেই, এর পাশাপাশি চিরতরে এদেশের মানুষের মনে একটি বার্তা গেঁথে দিয়েছে যে, ‘তুমি এখনও স্বাধীন নও’। আর ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই স্বাধীনতার জন্য তৃষিত বাঙালীদের সংগ্রামের শুরু। ভাষা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শেখ মুজিবুর রহমান সব সময়ই একটি সার্বভৌম বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন। আর সেই স্বপ্নকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসতে তাঁর সহনেতাকর্মীদের মধ্যেও এই চেতনা সঞ্চার করেছেন। সেই ফলশ্রুতিতেই ১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে লাহোর পৌঁছান। পরদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয় দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলনের আলোচ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানী পত্রপত্রিকায় ছয় দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। ফলে শেখ মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। বাঙালীদের একটি আলাদা সার্বভৌম ও স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার শুরু এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। ছয় দফায় প্রস্তাবিত দাবিগুলোর দিকে নজর দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে পাঠকদের জন্য।

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।

২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়- প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক। অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সংবলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে।

৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোন হারে আদায় করা হবে।

৫. দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোন শুল্ক ধার্য করা হবে না। রাজ্যগুলো যাতে যে কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।

৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।

এই দূরদর্শী ছয়টি দফার প্রত্যেকটিই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মাপকাঠিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সমকক্ষ করে তোলার একেকটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক এই তিন ক্ষেত্রে নিজ ভূখ-ের অভ্যন্তরে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়াই একটি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার প্রথম নিশানা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রতিটি দফাই এমনভাবে নক্সা করেছেন, যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ক্রমশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে স্বনির্ভর একটি নতুন রাষ্ট্রে পরিণত করে। অর্থাৎ বাঙালী জাতিকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর সব সময়ের মূল ভাবনা। ছয় দফার প্রথম দুটি দাবি পুরোপুরিই রাজনৈতিক। লাহোর প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, “ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাসমূহের মতো যেসব অঞ্চলে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব অঞ্চলে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (স্টেট বা প্রদেশ) গঠন করতে হবে, যার মধ্যে গঠনকারী এককগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।” অর্থাৎ এর পুনরাবৃত্তি নিশ্চিতকরণের দাবি উঠানো মানেই হচ্ছে বাঙালীরা নিজেদের ভূখ-ে নিজেদের ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের মূল রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাইছে।

দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবন্ধু আবারও নিশ্চিত করেছেন যে, লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে যেন বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যতীত আর কোন ক্ষমতা না থাকে। এটি মূলত তৎকালীন পাকিস্তানকে ক্রমশ সামরিক শাসনের বলয় থেকে বের করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দিকে আনয়নের একটি উদ্দেশ্য। জনগণের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস ন্যস্ত করার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান যে সেই শুরু থেকেই বদ্ধপরিকর ছিলেন তা এই দুই দাবিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অর্থনৈতিকভাবে পূর্বপাকিস্তান নিগৃহীত হয়ে আসছে ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর থেকেই। ধান, মসলা, চিনির মতো দেশের অভ্যন্তরের খাদ্য চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ফসল তো এই ভূখন্ডে প্রচুর হতোই, সেইসঙ্গে পাটের মতো অর্থকরী রফতানিযোগ্য পণ্যের মূল উৎপাদনস্থলও ছিল এই বাংলা। কিন্তু জাতীয় বাজেটে কখনই এই অবদানের বিনিময়ে কিছু পায়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। বিভিন্ন অর্থবছরে খাদ্য ঘাটতিও ছিল নিত্যদিনকার সমস্যা। তাই জনমনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাহিদা ছিল শুরু থেকেই। আর বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দাবি বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে আরও স্বনির্ভর করার চেতনা থেকেই উৎপত্তি। তিনি এখানে দুটি আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। তা সম্ভব না হলে বলেছেন, আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক তৈরি করতে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজ্য যেন নিজের আয় নিজের রিজার্ভে রাখতে পারে সেই দাবি তোলেন তিনি। অর্থাৎ, কোনভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের হাতে যেন বাংলার মানুষের পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সম্পদ পাচার হতে না পারে। তা এই তিনটি দাবির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তিনি। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের দূরদর্শী স্বপ্ন তিনি তখন থেকেই দেখতেন।

সবশেষের দফায় তিনি সরাসরি সামরিক সার্বভৌমত্ব দাবি করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীগুলোতে বাঙালী অফিসারদের পদোন্নতি দেয়া হতো না। বড় বড় মূল পদগুলোর একটিও পশ্চিম পাকিস্তানী ছাড়া অন্য কাউকে দেয়ার রেওয়াজই ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথমবারের মতো রাজ্য সরকারের হাতে অস্ত্র কারখানা তৈরি, নিজস্ব সামরিক বাহিনী প্রস্তুতকরণ প্রভৃতি বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দাবি করেন এই দফায়।

সর্বোপরি ছয় দফাকে শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালী স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রথম ড্রাফট হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়। কেননা, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীতে একের পর এক যা ঘটেছে ইতিহাসের পাতায় তাই বাংলাদেশকে স্বাধীন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। অন্যভাবে বললে বাঙালীও বঙ্গবন্ধুর মূল স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে।

একটা গল্প দিয়ে শেষ করা যাক।

ছয় দফা ঘোষণার পর তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং ন্যাপের প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,

-আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?

আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব,

-আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।

এই এক দফার ফলাফলই আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

 

 

 

 
 
 
 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *