‘সেই একটা সময় ছিল ত্যাগ-ব্রতের রাজনীতি, তাদের ঘিরে যারা জড়ো হতেন তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছিল। রাজনীতি চর্চার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ ছিল, চরিত্রে সংহতি ছিল। তারা দেশের মানুষকে ভোটার বা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়িই শুধু ভাবতেন না, বড় করে দেখতেন। আমাদের মনি সাহেব ছিলেন এই দলের মানুষ। মনি ভাইকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম।’ কবি আসাদ চৌধুরীর এমন ভাবনার মাঝেই শেখ ফজলুল হক মনির ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের দর্শন ফুটে উঠেছে।
শেখ ফজলুল হক মনি, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি নাম, একটি ইতিহাস। যার হাত ধরে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যুব রাজনীতির বীজ রোপিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশের কল্যাণকামী যুবসমাজকে সাথে নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নেতৃত্ব গুণাবলী, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এদেশের যুব সমাজের আইকন। যিনি নিজ মেধায় হয়ে উঠেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের যুব রাজনীতি ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নক্ষত্র, বহুগুণে গুণান্বিত এবং বিরল প্রতিভার অধিকারী শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম শেখ নূরুল হক বঙ্গবন্ধুর নিকটতম আত্মীয় এবং ভগ্নিপতি। মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডে বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর রাখায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বোন আছিয়া বেগমের কাছ থেকে শেখ মনিকে চেয়ে নেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর হাতেই রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের হাতেখড়ি হয় শেখ মনির।
১৯৬০-৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় তৎকালীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের জোরালো আন্দোলনে বলিষ্ঠ হাতে নেতৃত্ব দেন শেখ মনি। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেয়া শরীফ কমিশনের অগণতান্ত্রিক ও শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন।
শেখ ফজলুল হক মনি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই অসীম সাহসী ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। আর একারণেই ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ফলশ্রুতিতে মোনায়েম খান ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেন। পরে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে তিনি তার অর্জিত ডিগ্রি ফিরে পান।
শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব বাংলার মুক্তির সনদ তথা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা পালন করা। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে সারাদেশ ব্যাপী হরতাল সফল করে তোলার অগ্রসেনানী ছিলেন শেখ মনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ওই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম হয়তো পিছিয়ে যেত। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে এ অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। এসময় বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ কারাবাস শেষে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান।
দেশ এবং দলের প্রয়োজনে যেকোনো ধরণের ত্যাগ স্বীকারের মূর্ত প্রতীক ছিলেন শেখ মনি। যার প্রমাণ মেলে ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের সময়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে এমপি হওয়ার সকল ধরণের সুযোগ এবং সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তিনি দেশব্যাপী বৃহত্তর পরিসরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক- বীমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ শতাংশ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শেখ মনি।
৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে দেহ মাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন শেখ মনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের লক্ষ্যে দেশের মুক্তিকামী যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন মুজিব বাহিনী। তিনি ছিলেন উক্ত মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক।
শেখ ফজলুল হক মনি শুধুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, মনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল দার্শনিক, একজন প্রথিতযশা লেখক ও সাংবাদিক। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। শেখ মনি ছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। শেখ মনির লেখা ‘অবাঞ্ছিতা’উপন্যাস পাঠক সমাজেও প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক।
রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখে স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন শেখ মনি। এর প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধু কতৃক ১৯৭৫-এ জাতীয় ঐক্যের রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠনের পর শেখ ফজলুল হক মণি বাকশালের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে।
৭৫ এর ঘাতকরা খুব ভালোভাবেই তা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলো বলেই ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার লক্ষ্যে পরিচালিত আক্রমণের প্রথম শিকার হন শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্বা স্ত্রী আরজু মনি। ঘাতকরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো শেখ মনি বেঁচে থাকলে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।
যতদিন পৃথিবীর আকাশে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়বে ততোদিন এদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলার যুব রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ ফজলুল হক মনি। ব্যক্তি শেখ মনির মৃত্যু হলেও শেখ মনির স্বপ্নের যুবলীগ ও তাঁর আদর্শ চির অম্লান।
বর্তমান যুবলীগের নেতৃত্বে থাকা শেখ মনির সুযোগ্য সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রতিচ্ছবি মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ শেখ মনির আদর্শ লালন করে তাঁর স্বপ্নের “অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ” বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
লেখক -শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন