23
Dec

বিতর্কিত জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর গতকালই প্রথমবারের মতো হংকং-এর আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পূর্বের নির্বাচনগুলোর চেয়ে এবারের নির্বাচন অনেকাংশেই বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ এবারের নির্বাচনে হংকং সরকারের আধিপত্য এতটাই প্রকট যে, এ নির্বাচনকে পরোক্ষভাবে ‘চীনা দেশপ্রেমিকদের’নির্বাচনও বলা হচ্ছে। শুধু চীনা দেশপ্রেমিকরাই যেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে তা নিশ্চিত করতে চীনপন্থি হংকং প্রশাসন একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। সরকারের এসব পদক্ষেপ ও চীনের প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপের কারণে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে এবারের নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফলাফল ব্যাপক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। এবারের নির্বাচনে গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। লেজিসলেটিভ কাউন্সিল নির্বাচনে  ৪৪ লাখ ৭২ হাজার ৮৬৩ জন নথিভুক্ত ভোটারের মধ্যে মাত্র ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৬৮০ জন ভোট দিয়েছেন।

১৯৯৭ সালের ১ জুলাই যখন হংকং-এর শাসন ব্যবস্থা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে গণচীনের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন থেকেই হংকং ‘এক দেশ, দুই নীতি’ পদ্ধতির আওতায় স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। অর্থাৎ হংকং চীনের সরাসরি প্রশাসনিক বলয়ের বাইরে থেকে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে তার যাত্রা শুরু করে। এমনকি হংকং-এর নিজস্ব বিচার বিভাগ, আইনসভা ও নিরাপত্তা বাহিনীও রয়েছে যা কাগজে কলমে সম্পূর্ণভাবে চীনের প্রভাবমুক্ত। কিন্তু গত ১১ মার্চ ২০২১ সালে যখন ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস (NPC) এর তত্ত্বাবধানে “নির্বাচনী বিধি সংশোধন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নতি” নিশ্চিতের লক্ষ্যে হংকং স্পেশাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিজিয়ন (HKSAR) এর প্রধান নির্বাহী (CE) এবং লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের (LegCo) জন্য একটি নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তখন নব্য-গণতন্ত্রপন্থীরা এর ব্যাপক সমালোচনা ও বিরোধিতা করা শুরু করে। কারণ এই নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে শুধুমাত্র চীনা মতবাদ অনুযায়ী “দেশপ্রেমিক” নেতারাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং জনগণদের তাদের মধ্য থেকেই ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে।

এর আগে ২০২০ সালের জুনে হংকং-এর জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ার পরপরই এই নতুন নির্বাচনী পদ্ধতি গৃহীত হওয়ার ফলে গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো এবং বিরোধীদলীয় কর্মীরা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সরকারপন্থীদের নিকট এই আন্দোলনকে বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং গণতন্তের ধারাকে রোধ করার ষড়যন্ত্র হিসাবেই দেখা হয়েছিল। হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থিদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন এবং ভূখণ্ডটিতে চীনা নিয়ন্ত্রণ আরও শক্ত করার পর পুনর্গঠিত নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হল যে- হংকংয়ের মাটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো ভাবেই সহ্য করবে না শি জিনপিংয়ের প্রশাসন। এরই ফলশ্রুতিতে বেইজিং বিতর্কিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি ল পাশ করে এবং এটিকে হংকংয়ের বেসিক ল’তে সংযুক্ত করে যা হংকংয়ের বিচার বিভাগীয় স্বায়ত্তশাসন হ্রাস করে এবং বিক্ষোভকারীদের শাস্তির পথকে সহজ করে। এরপর থেকে ওই আইনের আওতায় অনেক সমালোচককে আটক করা হয়েছে যাদের অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। অনেকেই বিদেশে পালিয়ে যেতেও বাধ্য হয়েছেন।

সমালোচকরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, এই আইন বিরোধীদেরকে পার্লামেন্টের বাইরে রাখবে, যার অর্থ সেখানে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে। চীনের এ পদক্ষেপের অর্থ হলো যে কোন সম্ভাব্য সংসদ সদস্যর বিষয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগেই পরীক্ষা করে দেখা হবে যে তিনি চীনের প্রতি যথেষ্ট অনুগত কি-না। এদিকে হংকংয়ের সংবিধান এবং মূল ভূখণ্ড বিষয়ক মন্ত্রী এরিক সাং বিদেশে অবস্থিত সরকার বিরোধী গোষ্ঠীর ভোট বর্জন করার আহ্বানকে তীব্র সমালোচনা করে এই বলে সতর্ক করেছেন যে নির্বাচন ব্যবস্থাকে দুর্বল বা হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টাকে নস্যাৎ করতে সরকার সদা সতর্ক আছে। নতুন নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, ভোট বর্জন ও অবৈধ ভোট দিতে প্ররোচনা দিলে তিন বছরের জেল হতে পারে। লীগ অফ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস-এর তিনজন বিক্ষোভকারীকে ভোটকেন্দ্রের নিকটে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘আমরা চাই সার্বজনীন ভোটাধিকার’ এই স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করার কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সরকার যতই যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন, নতুন নির্বাচনী সংস্কার বিতর্কিত হওয়ার পিছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। নতুন সংস্কারে বলা হয়েছে, সেই সব প্রার্থীই ভোট দিতে পারবেন, যারা নিজেদের রাজনৈতিক ধারণা এবং দেশভক্তির বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। আইনসভার ৯০ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ২০ জন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আইনসভার ৪০টি আসনে প্রতিনিধি ঠিক করে দেয় এক হাজার ৫০০ জনের একটি কমিটি। কমিটিতে শুধুমাত্র কট্টর চীনপন্থিরাই আছেন। ৩০ জনকে বেছে নেয় বেইজিং-পন্থি আরেকটি কমিটি। তবে এই প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ও বিশেষ শিল্প গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। নির্বাচনকালীন সময়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বুথগুলিতে দশ হাজার পুলিশ ও ৪০ হাজার সরকারি নির্বাচনী কর্মচারী মোতায়েন করা হয়েছিল। পুলিশ প্রধান রেমন্ড সিউ সাংবাদিকদের বলেন, শতাধিক পোলিং স্টেশনে যাতে মানুষ নিরাপদে ভোট দিতে পারে, তাই এই পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের মতে নির্বাচনে পুলিশবাহিনী মূলত সরকারের হুকুমই পালন করেছে।

হংকংয়ে ভোট না দেয়া বা খালি ব্যালট জমা দেয়া বেআইনি নয়। কিন্তু এই বছর থেকে নিয়ম চালু করা হয়েছে, কেউ যদি ভোট না দেয়ার জন্য উসকানি দেয়, তাহলে সেটা অপরাধ। চিফ সেক্রেটারি জন লি জানান, ‘যারা জনগণকে ভোটদান থেকে বিরত রাখতে চায় তারা বিশ্বাসঘাতক।‘ উল্লেখ্য, গতকাল অন্তত ১০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করার জন্য। বিদেশে থাকা পাঁচজন মানবাধিকারকর্মী ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে পুলিশ। ১৪ ঘণ্টা ধরে চলা ভোটের প্রথম সাত ঘণ্টায় ভোট পড়েছিল মাত্র ১৯ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে হংকং চীনের অধিকারে চলে যাওয়ার পর এত কম ভোট আর কখনো পড়েনি। যদিও কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছিল, ভোট দিতে আসার জন্য যানবাহনে চড়লে তাতে কোনো টাকা দিতে হবে না। এমনকি ভোটদাতাদের কাছে মেসেজ পাঠিয়েও ভোট দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আশানুরুপ অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্যমতে সরকারের অতিনিয়ন্ত্রণ ও জনগণের চাহিদাকে তোয়াক্কা না করার মনোভাব জনগণকে ভোটদানে বিরত হতে বাধ্য করেছে। নির্বাচনপূর্ব সমীক্ষাতেই এই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়েছিল যে, যে নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নেই সেই নির্বাচনে অংশগ্রহনেও জনগণের উৎসাহ নেই। পশ্চিমা বিশ্ব এই নির্বাচনকে হংকংয়ে ‘গণতন্ত্রের অপমৃত্যুর নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে।

লেখক: শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

Leave A Comment