Deprecated: version_compare(): Passing null to parameter #2 ($version2) of type string is deprecated in /home/sheitefm/public_html/wp-content/plugins/elementor/core/experiments/manager.php on line 132
শুভ বড়দিন – আত্মত্যাগেই নিহিত মানবতার জয়গান - Sheikh Mohammad Fauzul

বছর শেষ হতে চলল, আর হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। তার পরই একটা নতুন বছরের সূচনা। তবে তার আগে আছে এক বিরাট উৎসব। পঁচিশে ডিসেম্বর পালিত হয় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন বা ক্রিসমাস ডে। ফিলিস্তিনের বেথেলহেমে এই দিনে এক জরাজীর্ণ গোয়ালঘরে জন্ম নিয়েছিলেন এক মহামানব, যার নাম যিশু খ্রিষ্ট। তখন থেকেই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটিকে বড়দিন হিসেবে পালন করে আসছে। দেড় হাজার বছরের অধিক কাল ধরে পালিত হয়ে আসছে বড় দিন। ব্যাপক আড়ম্বরের মাধ্যমে দেশে দেশে এ দিনটি পালিত হয়। সান্তা ক্লজের আবির্ভাব, ক্রিসমাস ট্রি, আলোকসজ্জা, উপহার, কেক, মজাদার খাবার, গীর্জায় প্রার্থনা এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্যে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীগণ দিনটি কাটান পরম আনন্দে। এটি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।

বড়দিনের ইতিহাস হিসেবে জানা যায়, যীশুর মা মাতা মেরী ছিলেন ইসরায়েলের নাজারেথবাসী যোসেফের বাগদত্তা। একদিন এক দেবদূতের মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন, মানুষের মুক্তির পথ দেখাতে তাঁর গর্ভে আসছেন ঈশ্বরের পুত্র। তাঁর নাম রাখতে হবে যীশু। তিনি এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ভণ্ডামিতে ভরে উঠেছিল পৃথিবী। মানুষের মধ্যে না ছিল শুদ্ধতা, না ছিল নীতি-নৈতিকতা। খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, যীশুর জন্মকালে আকাশ থেকে ভেসে এসেছিল দৈববাণী, “তোমাদের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীতে এ রাতে ঈশ্বরের পুত্র এসেছেন।”

ইতিহাস অনুযায়ী রোমান সাম্রাজ্যের সময় ৩৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বড়দিনের উৎসব পালন করা হয়। পোপ জুলিয়াস প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে বড়দিন উৎসব পালন করার ঘোষণা দেন। সেই থেকে দেশে দেশে এই দিনটি পালন হয়ে আসছে। এর আগে বড়দিনের উৎসব তেমন জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না এবং তা ইউরোপের বাইরে ছড়ায়নি। তবে উৎসবটি জনপ্রিয়তা পায় মধ্যযুগে, যা বর্তমানে সার্বজনীন উৎসবে রুপ নিয়েছে। আর এই ক্রিসমাসের এই অন্যতম আকর্ষণ হল লাল পোশাক, লাল টুপি পরা সাদা ধবধবে দাঁড়ি-গোঁফ ওয়ালা সান্তা ক্লজ। সান্তা ক্লজের আবির্ভাব ঘটে খ্রিষ্টীয় ৩ শতকে সেন্ট নিকোলাস নামে এক সন্ন্যাসীকে কেন্দ্র করে। ২৮০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ এশিয়া মাইনর বা বর্তমানে তুরস্কের পাতারা-তে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তাঁর অসম্ভব সততা এবং দয়াশীলতার জন্য তাঁকে সবাই খুব পছন্দ করত। বিপুল সম্পদের অধিকারী এই ব্যক্তি সবসময় গরীব ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করতেন।

ক্রিসমাসে বিশেষ করে ছোট্ট শিশুদেরকে উপহার দেওয়ার রীতি শুরু হয় উনিশশো শতকের গোড়ার দিক থেকে। ১৮২০ সাল থেকে ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দোকানে দেওয়া হত বিজ্ঞাপন, পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হত যেখানে সান্তা ক্লজের ছবিও ছাপা হতো। ১৮৪১ সালে ফিলাডেলফিয়ার একটি দোকানে একটি মানুষরূপী সান্তা ক্লজ তৈরি করা হয় যা দেখতে ভিড় জমিয়েছিল প্রায় কয়েক হাজার শিশু। আর এরপর থেকেই শিশু এবং তাদের বাবা-মায়েদের আকৃষ্ট করতে দোকানে দোকানে জীবন্ত সান্তা ক্লজ সাজানো হয়। প্রসঙ্গত, আজকের সান্তা ক্লজের যে রূপ চোখে পড়ে, তা কিন্তু এসেছে, ”An Account of a Visit from St. Nicholas”- শীর্ষক একটি কবিতা থেকে। ১৮২২ সালে “ক্লেমেন্ট ক্লার্ক মুর” নামে একজন ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে এই কবিতাটি লেখেন। লাল পোশাক, কালো বেল্ট সাদা বর্ডার দেওয়া লাল টুপি পরা সাদা দাঁড়িওয়ালা এক ব্যক্তি ৮টি হরিণ টানা স্লেজ গাড়িতে উড়ে উড়ে ছোটদের বাড়ি গিয়ে উপহার বিতরণ করছে- এমনই এক চিত্র ফুটে উঠেছিল তার সেই কবিতায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই কবিতা খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

বড়দিন মানেই ক্রিসমাস ট্রি। যে গাছটি বাহারি সব ফুল ফল রঙিন আলোকমালায় সাজানো হয়। ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে যে গাছটি বেশি ব্যবহার হয় সেটা হল ফার গাছ। এটা দেবদারু জাতীয় গাছ। প্রকৃত গাছ ব্যবহার না করে এখনো অনেকে প্লাস্টিকের গাছ ব্যবহার করেন। প্রথম দিকে এটি শুধুমাত্র রাজ দরবারে ও চার্চের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে। এই গাছের উপরে বিভিন্ন ধর্মীয় আইকন এবং একটি তারা বা স্বর্গ দূত বসানো হয়। এই স্বর্গ দূতটি বেথেলহেমে জন্ম নেয়া যিশু খ্রিষ্টের প্রতীক। ইতিহাস মতে ষোল শতকে জার্মানি তে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রচলন শুরু করা হয়। ক্রিসমাসের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জিঙ্গেল বেল। জিঙ্গেল বেল বড় দিনের সুর বেঁধে দেয়। এই সুর বেঁধে সান্তা ক্লজ ২৪ ডিসেম্বর রাতে আসেন উপহারের ঝুলি নিয়ে। বড়দিন উপলক্ষে ইংল্যান্ড এ থাকে পারিবারিক পুডিং। ইংরেজ সংস্কৃতি সম্পন্ন দেশে বড়দিনের ভোজ সভায় দেখা যায় টার্কি, আলু, শাক সবজি, মিন্স পাই ও ফ্রুট কেক। ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে বড়দিনের ভোজে মাছের প্রাধান্য থাকে। জার্মানি, অষ্ট্রিয়া ও ফ্রান্সে হাঁস ও শূকরের মাংস জনপ্রিয়। ক্রিসমাস এর বিশেষ মিষ্টির মধ্যে জার্মূ স্টোলেন, মার্জিনাল কেক উল্লেখযোগ্য।

অতিমারির করোনার সংকট মানুষকে একত্রিত হতে নিষেধ করলেও খ্রিষ্টের বাণী আজ জয়যুক্ত হচ্ছে সর্বত্র। কারণ করোনা ভাইরাসে যেখানে মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অসুস্থ মানুষকে এড়িয়ে চলছে, সেখানে একদল মানুষ দিনরাত সেবা দিয়ে নির্ভীকভাবে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ফ্রন্টলাইনের সেসব মানুষ তথা ডাক্তার-নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী প্রকৃতপক্ষে মহামানবের দেখানো পথে হাঁটছেন। পৃথিবীতে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল যীশু খ্রিষ্টের অন্যতম ব্রত। মহামতি যীশু বিপন্ন ও অনাহারক্লিষ্ট মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে এবং শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

আজকের দিনে যিশুর ক্ষমার বাণী আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন। সারা বিশ্বব্যাপী যে বিভেদের সুর বাজছে তা থেকে বিরত থাকতে এবং বিভেদ বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে যিশুর বাণী আর বড়দিনের তাৎপর্য উপলব্ধি করা দরকার। স্রষ্টার প্রেরিত মহাপুরুষ হিসেবে মুসলমানরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি আত্মত্যাগ ও সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও সাড়ম্বরে বড়দিন পালিত হয়ে আসছে। পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে বড়দিন উপলক্ষ্যে বিশেষ সাজসজ্জা ও মজাদার খাবার-দাবারের আয়োজন করে থাকে। বড় বড় বিপনী বিতানগুলোও সেজে উঠে বড়দিনের বর্ণিল সাজে। খ্রিষ্টানসহ প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা যেন তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতে পারে সে ব্যাপারে বর্তমান সরকার সচেষ্ট ভূমিকা পালন করছে। এ পূণ্যদিন উপলক্ষ্যে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়সহ জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলই মানবতার কল্যাণে আত্মত্যাগের মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসুক – এটাই কামনা।

লেখকঃ শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *