রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে গঠিত বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, আজ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে কোম্পানির মাধ্যমে বাস চলাচল শুরু হচ্ছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর রুটে কোম্পানির মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় ৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ১৫৭টি বাস পরিচালনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে প্রথমে ৫০টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু হবে,, যার মধ্যে বিআরটিসির ৩০টি বাস এবং ট্রান্সসিলভার ২০টি বাস রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে এই রুটে মোট ১০০টি বাস চলাচল করবে। বাসগুলোতে সবুজ রঙ করা হবে। গত ১৯ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের বুড়িগঙ্গা হলে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ২০তম সভা শেষে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রায় ২১ কিলোমিটারের এই রুটে বাসভাড়া হবে প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ১৫ পয়সা। ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রথম দিন থেকেই এ রুটের বাসগুলোতে ই-টিকেটিং সিস্টেম চালু করা হবে। সকল বাস বে, যাত্রী ছাউনিগুলোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া প্রতি বাসের ড্রাইভার ও স্টাফদের নির্দিষ্ট পোশাক থাকবে এবং তাদের গলায় আইডি কার্ড ঝোলানো অবস্থায় থাকবে। নির্দিষ্ট রঙয়ের বাস ও রুট নাম্বারের মাধ্যমে সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই বাস সার্ভিস পরিচালিত হবে। যেসব বাসের রেজিস্ট্রেশন এবং রুট পারমিট আছে তারাই কেবল এই রুটে বাস পরিচালনা করতে পারবে।
দক্ষিণ সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, কোম্পানির মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে এ রুটে ট্রান্সসিলভা ৩৮টি, ইকবাল এন্টারপ্রাইজ ২টি, এমএল লাভলি পরিবহন ৪টি, রজনীগন্ধা পরিবহন ১টি, মোস্তফা হেলাল কবির ৬টি, মোহাম্মদ ওলিউল্লাহ ১টি, জাহান এন্টারপ্রাইজ ১০০টি ও এইচআর ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ৫টি বাস পরিচালনায় আগ্রহ দেখিয়েছে। কমিটির ১৯তম সভা শেষে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস অংশীজনদের সুবিধা-অসুবিধার কথা আমলে নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালুর জোর প্রতিশ্রুতি দেন। সেই লক্ষ্যে চলতি মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের আহবান জানানো হয়। পরে এই সময়ের মধ্যেই আট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই রুটে ১৫৭টি বাস পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করে নাম জমা দেয়।
দৈনিক বাস-রুট ব্যবস্থাপনা এবং অপারেটরদের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিত করাটা সমন্বিত নগর পরিবহণ ব্যবস্থার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং জনসংখ্যার ঘনত্বও এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই সঠিকভাবে রুট ও বাস বিন্যাস নিশ্চিত করতে পারলে এই নগর পরিবহণ ব্যবস্থা প্রকৃতভাবে সাফল্যের মুখ দেখবে। একই সাথে সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থা, লেন বিন্যাস এবং পিক-অফ পিক আওয়ার বিবেচনা করে বাসের সংখ্যা নির্ধারণ করাটা অতীব জরুরী। চায়না, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও কলম্বিয়াসহ অনেক দেশই ইতোমধ্যে সমন্বিত নগর পরিবহণ ব্যবস্থা অনুসরণ করে যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। সমন্বিত নগর পরিবহণ ব্যবস্থার পাশাপাশি যদি মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ব্যবহার সুচারু ভাবে চালু করা সম্ভব হয়, তাহলে ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা অনেকাংশেই সহজ ও সুলভ হয়ে উঠবে। একই সাথে অন্যান্য নাগরিক সুযোগ সুবিধার সুষ্ঠু প্রাপ্যতাও নিশ্চিত হবে।
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আরেকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মহাসড়কগুলোতে রিকশা-ভ্যান প্রভৃতি ধীর গতির যান চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করা বা পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করা। ২০১৯ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ। বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত মালিকানা হিসেব করলে ভ্যানের সংখ্যাও প্রায় ৫ থেকে ৬ লক্ষ। এই ধীরগতির যানবাহনগুলো একদিকে যেমন যাত্রার সময় বৃদ্ধি করছে, অপরদিকে রাস্তায় আকস্মিক ট্রাফিক জ্যামও সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর বার্ষিক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৮ লক্ষ ৮৬ হাজারেরও অধিক নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে। এই মোটরসাইকেলগুলোর জন্য কোন নির্ধারিত লেন ব্যবস্থা না থাকায় ও যত্রতত্র পার্কিং করার কারণেও ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সমন্বিত নগর পরিবহণ ব্যবস্থার পরিপূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না।
রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন ও শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে এক কোম্পানির মাধ্যমে বাস সার্ভিস চালু করার পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। একই সাথে জনগণের বিভিন্ন নাগরিক সমস্যারও সমাধানের পথও সুগম হবে। এর মাধ্যমে নগরে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে। সমন্বিত বাস সার্ভিস চালুর মাধ্যমে একদিকে যেমন জনদুর্ভোগ বহুলাংশে হ্রাস পাবে, সেই সাথে গণপরিবহণ কর্মীরাও রোটেশন পদ্ধতিতে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে। চালকদের মাঝে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব থাকবে না। ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ এর মাধ্যমে বাস্তবিক অর্থেই ঢাকায় গণপরিবহনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।
লেখকঃ শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ