সারা বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে ইতিমধ্যে করোনা মহামারীর কল্যাণে আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা এই গ্রীক অক্ষরগুলি অনেক পরিচিতি লাভ করেছে। এই ধারায় অতি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘ওমিক্রন’ ভেরিয়েন্ট। এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পাঁচটি উদ্বেগজনক ভেরিয়েন্টের নামকরণ করেছে। এদের আসল বৈজ্ঞানিক নাম থাকলেও তা সহজে বোধগম্য না হওয়ায় সাধারণত এসব নামকরণ করা হয়। করোনা ভাইরাসের যুক্তরাজ্য ভেরিয়েন্টকে আলফা, দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্টকে বিটা, ব্রাজিলের ভেরিয়েন্টকে গামা, ভারতীয় ভেরিয়েন্টকে ডেল্টা এবং বতসোয়ানা-দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্টকে ‘ওমিক্রন’ নামে ডাকা হয়।
চীনের উহানে করোনা ভাইরাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার ছোট ছোট মিউটেশন ঘটেছে তবে হাতে গোনা ৪/৫ টি ছাড়া প্রায় সবগুলি কোন ধরনের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। মৃত্যুহারের বিবেচনায় আলফা, বিটা, গামা এবং ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এর নাম এখন সবার মুখে মুখে। শুধু উপরোক্ত ভেরিয়েন্টগুলি এতদিন সবচেয়ে বিপদজনক ছিল। এমন অবস্থার পরিপেক্ষিতে চলতি বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রথমে বতসোয়ানায় এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার গৌটেং প্রদেশে বি.১.১.৫২৯ নামের একটি মিউটেশনের খোঁজ পাওয়া যায়। যা দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা জিনোম সিকোয়েন্স করে এযাবৎকালের সর্বাধিক মিউটেশন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বিপদজনক এবং ভয়ঙ্কর ভেরিয়েন্ট হিসাবে চিহ্নিত করে। যা নভেম্বর ২৬, ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘ওমিক্রন’ নামকরণ করে।
গত বছরের অক্টোবরে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের উদ্ভব ঘটলে তা দ্রুত বিস্তার হতে থাকে। একই সময়ে ব্রাজিলের গামা ভেরিয়েন্টও বিস্তার লাভ করে। কিন্তু ডেল্টা ভেরিয়েন্ট অতিমাত্রায় সংক্রমণ এবং বিস্তারের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ায় তা পূর্বের আলফা, বিটা এবং গামা কে সহজেই হারিয়ে সারা বিশ্বে মূলত এককভাবে অতি দ্রুত বিস্তার করতে থাকে। ২০২১ সালে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে বার বার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট আঘাত হানতে থাকে। এমনকি বাংলাদেশেও জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত একাধিকবার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট আঘাত হানে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি আঘাত আসে এপ্রিল এবং জুলাই-আগস্ট মাসে। প্রতিদিন বিশ্বে এখনো ছয়-সাত লক্ষ আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হচ্ছে এবং ছয়-সাত হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে এই ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে।
ইতোমধ্যেই ৫০ টিরও বেশি মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটেছে এই ‘ওমিক্রন’ ভেরিয়েন্টে, যার ৩০ টির বেশি ঘটেছে স্পাইক প্রোটিন অংশে যেটাকে কেন্দ্র করে বর্তমানে ব্যবহৃত সব ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হয়েছিল। কেবলমাত্র এ কারণে বিজ্ঞানীরা চলমান ভ্যাকসিন কার্যকরী হবে কিনা সে ব্যাপারে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে। এছাড়াও দশটির মত মিউটেশন হয়েছে ভাইরাসের শরীরের বাইন্ডিং অংশে যার মাধ্যমে ভাইরাস প্রথমে মানবদেহের সেলের সংস্পর্শে আসে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অংশে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এর ক্ষেত্রে মাত্র তিনটি মিউটেশন হয়েছিল। যে কারণেও বিজ্ঞানীরা ‘ওমিক্রন’ নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বের ৮৯ টি দেশে এই ‘ওমিক্রন’ আক্রান্ত ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে। অমিক্রনের প্রকোপে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোট আক্রান্ত ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইউরোপে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি ছাড়িয়েছে। সংস্থাটি বলছে, আগামী কয়েক মাসে ইউরোপে মোট কোভিড সংক্রমণের অর্ধেকই হতে পারে ওমিক্রনের কারণে। এছাড়াও আক্রান্ত দেশ গুলি্র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, হংকং, ইসরায়েল, জাপান ও ইন্ডিয়া। নেদারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সহ কিছু কিছু দেশে প্রত্যাশার আগেও এই ভেরিয়েন্টটি চলে এসেছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমান পাচ্ছেন। S-জিন ড্রপ আউট বৈশিষ্ট্যের কারণে জিনোম সিকোয়েন্স ছাড়াই আগের মতই সাধারণ আরটি-পিসিআর মেশিনের মাধ্যমে আক্রান্তকারীকে শনাক্ত করা যায়।
তবে ‘ওমিক্রন’ নিয়ে এখনো হাজারটা প্রশ্ন রয়েছে যার উত্তর বিভিন্ন গবেষনার মাধ্যমে পেতে অনেক সময় দরকার। তবে তার জন্য অপেক্ষায় না থেকে অনেকগুলি জরুরি পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য এক্ষুনি নেয়া দরকার। সর্বত্রই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা, অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি এগুলো মানার ব্যাপারে বিরামহীন প্রচার এবং কঠোর নজরদারি প্রণয়ন করা; বিমানবন্দর, সমুদ্র বন্দর এবং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ‘ওমিক্রন’ আক্রান্ত অন্যান্য ৮৯ টি দেশ থেকে আগত সকল যাত্রীদেরকে বাধ্যতামূলক আরটি-পিসিআর টেস্ট করা এবং প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা। ‘ওমিক্রন’ এ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হলে কন্টাক্ট ট্রেসিং করে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা ও দক্ষিণ আফ্রিকা হতে গত এক মাসে ফেরত সকলকে কার্যকরী কোয়ারেন্টাইনে রাখাও অতি জরুরী।
‘ওমিক্রন’ বাংলাদেশে প্রবেশ করবে না কিংবা মহামারি আকারে দেখা দিবেনা এসব অমূলক চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে বরং ‘ওমিক্রন’ মহামারি আসবেই এবং তা ঠেকানো যাবে না তা ভেবেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া উচিত। মহামারি আসলে যেন তা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর না হয় এবং হসপিটাল ও হেলথকেয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যেন ভেঙে না পড়ে সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। করোনার সকল হাসপাতাল, নার্স, ডাক্তার, বয়, অক্সিজেন সাপ্লাই, আইসিইউ বেড, স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রীর পর্যাপ্ততা এবং প্রস্তুতি এক্ষুনি নিয়ে রাখতে হবে। টেস্টের সংখ্যা যেন অতি দ্রুত বৃদ্ধি করা যায় সে ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে হবে। প্রতিমাসে ৪ বা ৫ কোটি টিকা দিয়ে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে টার্গেট গ্রুপের সমস্ত লোককে প্রথম ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং এর মধ্যে টার্গেট গ্রুপের অন্তত ৫০ শতাংশ লোককে দ্বিতীয় ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব ১৩ মিলিয়ন কিংবা সম্ভব হলে পঞ্চাশোর্ধ ৩০ মিলিয়ন লোকের জন্য বুস্টার ডোজ এর ব্যবস্থা করতে হবে।
মানুষদের মধ্যে টিকা দিয়ে করোনাভাইরাস এর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যতটা সম্ভব বাড়ানো যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, ‘ওমিক্রন’ আসার প্রাক্কালে উন্নত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ এই মুহূর্তে বুস্টার ডোজ এর উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করছে। ‘ওমিক্রন’ ভেরিয়েন্টকে প্রতিরোধ করবার জন্য মডিফাইড ভ্যাকসিন এর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েও রাখছে তারা। আমাদেরও প্রয়োজন এইসব টিকার সংস্থান এবং মজুদের একটি কন্টিনজেন্সি প্লান তৈরি করে রাখা। সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পূর্ব প্রস্তুতিই পারে করোনার এই নতুন ধরনের আক্রমণের হাত থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখতে।
লেখক: শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ