04
May

১৯৭২ সাল। তখনও সদ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির অভাব আর দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সেই অভাব পূরণে সংগ্রামেরত। এমন অবস্থায় সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভÑ জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে সামনে রেখে ক্রমাগত উন্নয়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ যুবকদের নিয়ে একটি নতুন অঙ্গ সংগঠন তৈরি করে। সেই প্রেক্ষিতেই ১৯৭২ সালের ১১ নবেম্বর মুজিববাদকে আদর্শ মেনে নিয়ে জন্ম নেয় আওয়ামী যুবলীগ।

তবে যুবলীগের শুরুর দিকের গল্পটা বলতে হলে একটি নাম উল্লেখ করতেই হবে। তিনি হলেন যুব রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ ফজলুল হক মনি। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল সংগ্রামেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন মনি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনের নিমিত্তে তার নির্দেশে দেশের কল্যাণকামী যুবসমাজকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুবলীগ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি নাম। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ গড়তে গিয়ে যুবলীগ নেতা বগুড়ার আব্দুল খালেক খসরু, চট্টগ্রামের মৌলবি সৈয়দ আহমদ জীবন দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুবলীগই সর্বাগ্রে নেতৃত্ব দিতে থাকে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত যুবলীগের সক্রিয় কর্মী শহীদ নূর হোসেনের রক্তে অর্জিত হয়েছে এদেশের গণতন্ত্র।

দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যুবলীগের সুনাম, ঐতিহ্য হোঁচট খেয়েছে বারবার। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি- যুবলীগের বিরুদ্ধে জনগণের মনে এইসব অভিযোগই লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।

সর্বশেষ ২০১৮-১৯ সালে গোপন সূত্রের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন বাসায়, অফিসে ও ক্লাবে অভিযান চালিয়ে খুঁজে পায় অসংখ্য অবৈধ ক্যাসিনো। পরবর্তীতে দেখা যায় এই পুরো ক্যাসিনো ব্যবসার পেছনেই জড়িয়ে আছেন সুযোগসন্ধানী ক’জন যুবলীগ নেতা। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একে একে মিলতে থাকে যুবলীগের বিভিন্ন নেতার অবৈধ সম্পদ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির কালো ইতিহাস। যুবলীগ থেকে এদের বহিষ্কার করা হলেও একটি দল হিসেবে যুবলীগের ভাবমূর্তি একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকে এই সময়টায়।

তবে এই পরিমাণ কেলেঙ্কারি ও জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যুবলীগকে পুনরায় প্রাণবন্ত করার চেষ্টা থেকে সরে আসেননি। শুরুতেই আওয়ামী লীগ নতুন নেতৃত্বের হাতে অঙ্গ সংগঠনটির ক্ষমতা ন্যস্ত করে। মেধাবী ও রুচিশীল ব্যক্তিত্ব শেখ ফজলে শামস পরশকে চেয়ারম্যান এবং ক্লিন ইমেজের অধিকারী ও তৃণমূল মানুষের কাছে জনপ্রিয় মাইনুল হোসাইন খান নিখিলকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে। নতুন কমিটির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরপরই তারা একের পর এক নতুন কর্মসূচী হাতে নেয়ার মাধ্যমে অসহায় ও দুস্থ মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে। পরশ-নিখিল যুবলীগের নেতৃত্বে আসার পরপরই সঙ্কট কাটিয়ে যুবলীগের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে নতুন উদ্যমে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে দলটি। যাত্রা শুরু হয় নতুন এক মানবিক যুবলীগের। করোনাকালীন গরিব ও খেটে খাওয়া প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে খাবার দিয়ে এখন অবধি সহায়তা করেছে যুবলীগ। এছাড়াও রমজান মাসজুড়ে অসংখ্য এতিমখানায় ইফতার সরবরাহ করছে সংগঠনটির বিভিন্ন নেতা। মহামারীর সময় বোবা ও বধিরদের সাহায্যেও কাজ করছে যুবলীগ। এখন অবধি দেশের নানা প্রান্তে প্রায় ১০ লাখ মাস্ক বিতরণ করেছে যুবলীগ কর্মীরা।

দলটি তাদের কাজের পরিধি শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যান্ডেট ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির পথে দেশকে এগিয়ে নিতে তারা তাদের সেবাদান করার ইচ্ছাকে নিয়ে গেছে ডিজিটাল দুনিয়াতেও। নবনির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ১০০-এরও অধিক ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে টেলিমেডিসিন দেয়া হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ দেশের কৃষকরা। এই চিন্তাকে বুকে ধারণ করে তাদের সাহায্যেও কাজ করছে যুবলীগ। ধান কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি দিয়ে ফসলের মৌসুমে তাদের সাহায্য করছে যুবলীগের কর্মীরা। এছাড়াও বন্যার্তদের খাদ্য সহায়তা প্রদান, করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের মতো আপাতদৃষ্টিতে সাহসী কাজেও দেখা মিলছে যুবলীগের স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের। এগুলোর বাইরেও মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ‘গাছ লাগাই জীবন বাঁচাই’ স্লোগানকে সামনে রেখে যুবলীগ এখন পর্যন্ত ৩২ লাখের বেশি বৃক্ষরোপণ করেছে, যে কার্যক্রম এখনও চলমান।

এত এত সেবাধর্মী কর্মসূচী দলটির সাংগঠনিক কর্মকা-ের চরিত্রই পাল্টে দিয়েছে। আগে যেসব কর্মী নিয়মিত দলের বড় নেতাদের পিছু পিছু চলত, তোষামোদ করত, নতুন কমিটি আসার পর এই একই কর্মীরা মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটছে বিভিন্ন সাহায্য প্রকল্প নিয়ে। কারণ এটিই এখন যুবলীগের সক্ষমতা। নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রাত-দিন পরিশ্রম করে যেভাবে সেবাধর্মী কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে রেখেছেন, দলের কর্মীদের জন্যও তা চমৎকার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। সেইসঙ্গে দলের বড় নেতাদের মাঠে না নেমে শুধু কর্মীদের অর্ডার দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাও ভেঙ্গে দিয়েছে নতুন কমিটি। তোষামোদ বা উপহার দিয়ে এখন আর কোন কর্মীর পক্ষে পদ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বরং জনকল্যাণে একজন কর্মী কতটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে সেটাই বর্তমানে পদের সিঁড়ি বাইবার একমাত্র উপায়। দলের ভেতর এরকম একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়ায় সকল নেতা-কর্মীর মাঝেই মানুষের সেবায় কাজ করার ইচ্ছা দিন দিন আরও জোরালো হচ্ছে। ফলে সমাজে দেখা যাচ্ছে পরিবর্তনের এক নতুন হাওয়া।

একটি রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন হিসেবে যুবলীগের নতুন প্রত্যেকটি কর্মসূচী সমাদৃত হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে। সেইসঙ্গে দেশের যুবকরা খুঁজে পাচ্ছে ভাল কাজ করার অনুপ্রেরণা। এই সুস্থ প্রতিযোগিতা দলের স্থায়ী চেতনার অংশ হয়ে দাঁড়ালেই কেবল যুবলীগ দেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিবে ঠিক আগের মতো, যেমনটা স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

 

Leave A Comment