রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে যতটা জল ঘোলা করা হয় তা বাংলাদেশের সাথে অন্য কোনো দেশের সম্পর্ক নিয়ে আদৌ হয় না। এই জল ঘোলাটা যে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য আর চারপাশে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের বাইরেও আরও অনেক বিষয়ের ইংগিত বহন করে তা খোলাসা করে না বললেও সকলেই বুঝতে পারে। এই সম্পর্ক নিয়ে সত্য, আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ মিথ্যা বা মনগড়া তথ্যের ছড়াছড়িও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দিক বিবেচনা করলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য ও কর্মসূচি থেকে সরকার ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন পক্ষের মতবাদ সহজেই অনুমেয়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার বা সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল/পক্ষের অবস্থান, বক্তব্য বা কর্মকাণ্ড থেকে সহজেই বিশ্লেষণ সম্ভব বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সমীকরণ। ভারতবিরোধী মনোভাব কি আসলেই বাংলাদেশের বৃহৎ স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে নাকি এটি আমাদের অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা বা ভৌগোলিক রাজনীতির আরেকটা দাবার চাল সেটাও গভীরে গিয়ে ভাবার বিষয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব প্রচারের অগ্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে নুরুল হক নুর। এখানে বিশ্লেষণের দাবি রাখে এই প্রচার কি আসলে যুক্তিযুক্ত কারণে নুরের দেশের পক্ষে অবস্থান নাকি কূটনৈতিক বিষয়াদি আমলে না নিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সে এই পথ অবলম্বন করেছে। ধর্ষণ মামলার আসামি হিসেবে সে যেহেতু এখনো প্রমাণিত নয় সেহেতু তার ব্যক্তিগত নৈতিকতা বা দেশপ্রেম নিরূপণে আপাতত এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে গ্রহণ করা হচ্ছে না। কিন্তু এককভাবে দেশব্যাপী এই ধরনের একটি ক্যাম্পেইন পরিচালনা, কোনো চাকরি বা ব্যবসা না করেই ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস ইত্যাদি স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে ভারতবিদ্বেষী এই প্রচারণায় নুর কুশীলবমাত্র। নুরকে সামনে রেখে এর পেছনে আরেকটি বড় দল বা পক্ষ অর্থায়ন, কর্মসূচি নিরূপণ ও কৌশল প্রণয়নে কাজ করছে সেটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই তা সে পক্ষ ভালোই হোক বা খারাপ। তবে আসিফ নজরুল, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. কামালের মতো ব্যক্তিরা যে সেই বিশেষ পক্ষের সাথে যুক্ত তা প্রমাণিত হয় ধর্ষণ মামলার রায়ের আগেই নুরের পক্ষে তাদের এহেন নির্লজ্জ সমর্থনে। রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে যেকোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে এমন নগ্ন একপাক্ষিক বক্তব্য অসম্ভবই বটে। পেছন থেকে যারা নুরের কাজ করছে তারা আসলে বাংলাদেশের পক্ষে না বিপক্ষে তা সিদ্ধান্তে আসার জন্য সেই পক্ষ কারা এবং তাদের উদ্দেশ্য জানা জরুরি।
আপাত দৃষ্টিতে এই ধরনের অর্থায়ন সম্ভব শুধুমাত্র চীনের পক্ষেই বলে ধারণা করা যায়। একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র মনে করছে, বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বাড়াতে আর্থিক জোগানসহ নানা রকম ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশেরই আরেক বন্ধুপ্রতিম দেশ চীন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাথে চীনের বৈরী সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ এই ধারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ভৌগোলিকভাবেও ভারতকে কোণঠাসা করতে ভারতের সব থেকে কাছের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র থেকে ভারতকে আলাদা করে ফেলা চীনের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ইতোমধ্যে এই ধরনের কৌশল চীন অন্যান্য দেশে সফলভাবেই প্রয়োগ করেছে।
ভেবে দেখার মতো বিষয়, ভারতবিদ্বেষী কার্যক্রমে চীনের এই গোপন অর্থায়ন আমাদের জাতীয় স্বার্থকে ত্বরান্বিত করবে কি? ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি আমাদের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক কোনোভাবে লাভজনক কি না সেটার স্বরূপ নির্ধারণ জরুরি। যদিও বাংলাদেশ সরকার এখনো পর্যন্ত দুই পক্ষের সাথেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুচারুভাবে রক্ষা করে চলেছে। তবে গোপনে অর্থায়ন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপে এই অবস্থার পরিবর্তন হলে তা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর হবে না ।
সামগ্রিক জনমত বিবেচনায় এটি প্রমাণিত হয় ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বাংলাদেশে কোনো জাতীয় দাবি বা জাতীয় ঐক্য নয় বরং কোনো স্বার্থরক্ষায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়ে দেয়া একটি রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের সুচারু ধারা অব্যাহত রাখা এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্তগুলোতে নিজেদের অবস্থান জনগণের কাছে স্পষ্ট করা।
লেখক পরিচিতি: রাজনীতিক ও প্রযুক্তি ব্যবসায়ী