Deprecated: version_compare(): Passing null to parameter #2 ($version2) of type string is deprecated in /home/sheitefm/public_html/wp-content/plugins/elementor/core/experiments/manager.php on line 132
রাজনীতির তামাশাঘর - Sheikh Mohammad Fauzul

এপ্রিল, ২০১৮ – কোটা সংস্কার আন্দোলন। মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ধোয়া তুলে আন্দোলন-অবরোধ করে দেশকে স্থবির করে দেয়া হল। যার ফলে ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকুরিতে সকল প্রকারের কোটা বাতিল করতে সরকার বাধ্য হল। কিন্তু এর ফলাফল আসলে কি দাঁড়ালো?

প্রেক্ষাপট ০১- যে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলেন, দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে আত্মোৎসর্গ করলেন; তাদের অপরিসীম ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য রাষ্ট্র থেকে দেয়া কোটা সুবিধা চলে গেল। এদের মধ্যে অনেকেই হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, কিন্তু আজ তারা বঞ্চিত।

প্রেক্ষাপট ০২- একজন মহিলা যে তার পরিবার থেকে দূরে যেতে চায় না, যা কিনা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশও; তিনি তার বাবা-মার কাছে থেকে, তার পরিবারের কাছে থেকে চাকুরি করার অধিকার রাখে। কিন্তু নিজ এলাকায় চাকুরির কোটা তুলে দেয়ায় সেই মহিলা তার নিজ এলাকায় চাকুরি করার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হল।
প্রেক্ষাপট ০৩- আদিবাসীরা বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি। দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করার কারণে তারা অধিকাংশ মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। তাদের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে সরকার থেকে দেয়া আদিবাসী কোটার বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালানো শুরু হল। যার ফলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়ার ও সমাজের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যেই সুযোগ ছিল তা থেকে আদিবাসীদের বঞ্চিত করা হল।

সকলের জন্য সমান অধিকার বা মেধা যাচাইয়ে সমান সুযোগের কথা যারা বলেন, তারা উপরোক্ত ঘটনাগুলোর মাধমে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার অলীক সুখ লাভ করতে পারেন। কিন্তু এখানে কিছু কথা না বললেই নয়। শুধু মেধাই সবসময় যথেষ্ট নয়, এর সাথে অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতাও ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। মেধা যাচাইয়ের সমান সুযোগ তখনই দাবি করা যায় যখন সমাজের সবাই সমপরিমাণ সুযোগ পায়। উদাহরণ স্বরূপ আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার কথাই ধরা যাক। শুধু ভালো বোলার বলেই কিন্তু তিনি জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পাননি। তার ক্রিকেট জ্ঞান ও দল চালানোর মত দক্ষতা এবং তা দীর্ঘসময় ধরে প্রমাণের সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই তিনি অধিনায়ক হতে পেরেছিলেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে আন্দোলনের ফলে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো তাদের অধিকার হারালো, সেই আন্দোলনকে সমান অধিকারের আন্দোলন বলা কতটুকু সমীচীন। কারণ এখন তাদের জন্য সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার কোন পরিবেশই আর রইলো না। তাই কোটা সংস্কার আন্দোলন সত্যিকার অর্থে বঞ্চিতদেরই বঞ্চিত করেছে। যারা এটা অস্বীকার করে সাম্যের জয়গান গাইবে তাদের মানসিক পরিপক্বতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেই হয়।

এবার ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ নিয়ে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে আলোকপাত করা যাক। স্কুলের দুইটি ছাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হল, সারা দেশের ছাত্র সমাজ বিচারের দাবিতে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ফেটে পড়লো, ফলশ্রুতিতে সকলের দাবি মেনে নিয়ে সরকার সড়ক আইন সংশোধন করতে বাধ্য হল। কিন্তু একটি গোষ্ঠি একেও তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে ব্যবহার করল। সচেতন ছাত্র সমাজের কাছ থেকে এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সুবিধাবাদীদের সরকার বিরোধী সমালোচনা ও আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হল। বরঞ্চ সড়ক ও জনপথের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য সরকার দেশব্যাপী যে বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করছে, যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করছে সেগুলোই মানুষের প্রকৃত উপকারে আসছে। কিন্তু এই দুই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখন একটি গোষ্ঠী একত্রিত হয়েছে, যারা তাদের পুরো সময়টাই ব্যয় করে সরকার ও আওয়ামী লীগের নামে সমালোচনা করে।

সরকারের কোন উন্নয়ন প্রকল্পের সাফল্যই তাদের চোখে পড়ে না, সরকারের সব কাজেই তারা ব্যর্থতা খুঁজে পায়। আর সরকারের বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন বা প্রশংসা করারতো কোন প্রশ্নই উঠে না। এইসব ভুঁইফোড় নেতাদের কোন রাজনৈতিক দর্শন নেই, জনগণের রাজনীতি করার মত মানসিক পরিপক্বতাও নেই। দেশের সর্বস্তরের মানুষের উন্নতির জন্য সামগ্রিকভাবে চিন্তা করার সামর্থ্য তো একেবারেই নেই। মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে আর পুঁথিগত বিদ্যার উপরে ভর করে তারা আজ রাজনৈতিক নেতা। আর তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান ক্ষেত্রই হচ্ছে ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’। বাংলাদেশের মানুষের সহজ-সরল আবেগকে পুঁজি করে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপরে ভর করে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনীতির এক ‘তামাশাঘর’ তৈরি করেছে।

মানুষকে রাজনৈতিক বিনোদন বা তামাশা প্রদানের মাধ্যমে তারা নিজেদের আজ জনমানুষের নেতা হিসেবে দাবি করে; যদিও দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে চলার, তাদের সুখ-দুঃখ, দাবি-দাওয়া বুঝতে পারার মত যোগ্যতাই তাদের নেই। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইক-কমেন্ট করে রাতারাতি প্রচুর ফলোয়ার বানানো যায়, কিন্তু মানুষের পাশে থেকে রাজনীতির যে অভিজ্ঞতা তা অর্জন করা যায় না।

এই দুই আন্দোলনের প্রকৃত সুফল পাচ্ছে সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূর ও তার গড়ে তোলা ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ’ এর উচ্চপদস্থ নেতারা। সম্প্রতি তারা বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ দলগুলোর সাথে টেক্কা দেয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক দল ‘গণ অধিকার পরিষদ’ চালু করেছে। এই ভিপি নূর ও তার সহযোগী রাশেদ খান, ফারুক হাসান, মশিউর রহমান, সোহরাব হোসেন, আবু হানিফ, মাহফুজুর রহমান – এইসব নেতাদের কারো বয়সই ৩০ পার হয় নি। এদের অপরিপক্ব বক্তব্য, বড়দের সাথে কথা বলায় আদবের অভাব, তাদের বিরুদ্ধে মাদক-নারীসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির নজির দেখলে আশংকা জাগে যে এরাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির কাণ্ডারি হতে যাচ্ছে কি না। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে ড. রেজা কিবরিয়া, যিনি রাজনৈতিক সুবিধার জন্য গণ ফোরাম-এর সাধারণ সম্পাদকের পদ ত্যাগ করে ভিপি নূরের ‘গণ অধিকার পরিষদ’ এ যোগদান করেছেন। এই ধরনের বসন্তের কোকিলের মত নেতা দিয়ে দেশ তো দূরের কথা, দলেরই উন্নয়ন হওয়া সম্ভব না। কারণ নিজেদের ফায়দার জন্য যারা নীতির বিসর্জন দেয়, তারা কিভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে?

তাদের মত অপরিপক্ব ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যহীন ভুঁইফোড় রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে কখনোই একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখা যায় না। সরকার, প্রশাসন বা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতৃবৃন্দের কাছে তাদের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনীতি রাজনীতি খেলার সময় বা সুযোগ কোনটাই নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হাজারো রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনের সাথে সরকারকে প্রতিনিয়তই যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের জন্য এইসব রাজনৈতিক ছেলেখেলায় অংশগ্রহণ করা মানায় না, তাদের এরূপ কিছু করার সুযোগও নেই। কিন্তু রঙিন চশমা চোখে দিয়ে ঘরে বসে রাজনৈতিক বিনোদন উপোভোগ করা তথাকথিত সুশীল নাগরিক গোষ্ঠি যারা নূর-রাশেদ-ফারুক-মশিউর এদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছেন, আপনাদের ধারণাও নেই আপনারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে কোন অন্ধকার যুগের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে তাদের হাতেই দিতে হবে যারা মানসিকভাবে পরিপক্ব, যাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আছে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। যারা বিভিন্ন বিপদে বাংলাদেশকে দেখেছে, বিভিন্ন দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। যারা বাংলাদেশকে শুধু নোয়াখালী বা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখে না। যারা বাংলাদেশকে সমগ্র বিশ্বের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে, একটি সমগ্র জাতি হিসেবে দেখতে পারে এরকম দলই আমাদের দরকার। কিন্তু তা না করে আমরা যদি অপরিপক্ব, অবিবেচক নেতৃত্বের কাছে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতকে সমর্পণ করি তাহলে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যাবে তা ভাবতেও ভয় হয়।

গত ১২ বছরে বাংলাদেশের যেই অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে তা সমগ্র বিশ্বের কাছেই বিস্ময়কর। কিন্তু এইসব ভুঁইফোড় নেতাদের কাছে একবার ক্ষমতা গেলে বাংলাদেশের যে দুর্বার অগ্রগতি হচ্ছে, যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হচ্ছে তা অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সর্বোপরি তারা বাংলাদেশে উন্নতির যে যাত্রা শুরু হয়েছে তাকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। দেশের যুব সমাজকে ভুল পথে পরিচালিত করে তাদেরকে রাজনীতির ভুল তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা শিখাবে। সেই সাথে তরুণদের অনুপ্রেরণা ও কর্মস্পৃহাকে ক্ষুন্ন করে এমন একটি বিভাজন তৈরি করবে যা সমগ্র জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই এদের দুরভিসন্ধির ব্যাপারে আমাদের এখন থেকেই সতর্ক থাকা অতীব জরুরি।

লেখক : শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন

সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *