Deprecated: version_compare(): Passing null to parameter #2 ($version2) of type string is deprecated in /home/sheitefm/public_html/wp-content/plugins/elementor/core/experiments/manager.php on line 132
News - Sheikh Mohammad Fauzul - Page 2

ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট – বাস্তবতা বনাম করণীয়

সারা বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে ইতিমধ্যে করোনা মহামারীর কল্যাণে আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা এই গ্রীক অক্ষরগুলি অনেক পরিচিতি লাভ করেছে। এই ধারায় অতি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘ওমিক্রন’ ভেরিয়েন্ট। এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পাঁচটি উদ্বেগজনক ভেরিয়েন্টের নামকরণ করেছে। এদের আসল বৈজ্ঞানিক নাম থাকলেও তা সহজে বোধগম্য না হওয়ায় সাধারণত এসব নামকরণ করা হয়। করোনা ভাইরাসের যুক্তরাজ্য ভেরিয়েন্টকে আলফা, দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্টকে বিটা, ব্রাজিলের ভেরিয়েন্টকে গামা, ভারতীয় ভেরিয়েন্টকে ডেল্টা এবং বতসোয়ানা-দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্টকে ‘ওমিক্রন’ নামে ডাকা হয়।

চীনের উহানে করোনা ভাইরাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার ছোট ছোট মিউটেশন ঘটেছে তবে হাতে গোনা ৪/৫ টি ছাড়া প্রায় সবগুলি কোন ধরনের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। মৃত্যুহারের বিবেচনায় আলফা, বিটা, গামা এবং ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এর নাম এখন সবার মুখে মুখে। শুধু উপরোক্ত ভেরিয়েন্টগুলি এতদিন সবচেয়ে বিপদজনক ছিল। এমন অবস্থার পরিপেক্ষিতে চলতি বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রথমে বতসোয়ানায় এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার গৌটেং প্রদেশে বি.১.১.৫২৯ নামের একটি মিউটেশনের খোঁজ পাওয়া যায়। যা দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা জিনোম সিকোয়েন্স করে এযাবৎকালের সর্বাধিক মিউটেশন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বিপদজনক এবং ভয়ঙ্কর ভেরিয়েন্ট হিসাবে চিহ্নিত করে। যা নভেম্বর ২৬, ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘ওমিক্রন’ নামকরণ করে।

গত বছরের অক্টোবরে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের উদ্ভব ঘটলে তা দ্রুত বিস্তার হতে থাকে। একই সময়ে ব্রাজিলের গামা ভেরিয়েন্টও বিস্তার লাভ করে। কিন্তু ডেল্টা ভেরিয়েন্ট অতিমাত্রায় সংক্রমণ এবং বিস্তারের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ায় তা পূর্বের আলফা, বিটা এবং গামা কে সহজেই হারিয়ে সারা বিশ্বে মূলত এককভাবে অতি দ্রুত বিস্তার করতে থাকে। ২০২১ সালে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে বার বার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট আঘাত হানতে থাকে। এমনকি বাংলাদেশেও জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত একাধিকবার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট আঘাত হানে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি আঘাত আসে এপ্রিল এবং জুলাই-আগস্ট মাসে। প্রতিদিন বিশ্বে এখনো ছয়-সাত লক্ষ আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হচ্ছে এবং ছয়-সাত হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে এই ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে।

ইতোমধ্যেই ৫০ টিরও বেশি মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটেছে এই ‘ওমিক্রন’ ভেরিয়েন্টে, যার ৩০ টির বেশি ঘটেছে স্পাইক প্রোটিন অংশে যেটাকে কেন্দ্র করে বর্তমানে ব্যবহৃত সব ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হয়েছিল। কেবলমাত্র এ কারণে বিজ্ঞানীরা চলমান ভ্যাকসিন কার্যকরী হবে কিনা সে ব্যাপারে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে। এছাড়াও দশটির মত মিউটেশন হয়েছে ভাইরাসের শরীরের বাইন্ডিং অংশে যার মাধ্যমে ভাইরাস প্রথমে মানবদেহের সেলের সংস্পর্শে আসে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অংশে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট এর ক্ষেত্রে মাত্র তিনটি মিউটেশন হয়েছিল। যে কারণেও বিজ্ঞানীরা ‘ওমিক্রন’ নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বের ৮৯ টি দেশে এই ‘ওমিক্রন’ আক্রান্ত ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে। অমিক্রনের প্রকোপে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোট আক্রান্ত ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইউরোপে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি ছাড়িয়েছে। সংস্থাটি বলছে, আগামী কয়েক মাসে ইউরোপে মোট কোভিড সংক্রমণের অর্ধেকই হতে পারে ওমিক্রনের কারণে। এছাড়াও আক্রান্ত দেশ গুলি্র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, হংকং, ইসরায়েল, জাপান ও ইন্ডিয়া। নেদারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সহ কিছু কিছু দেশে প্রত্যাশার আগেও এই ভেরিয়েন্টটি চলে এসেছে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমান পাচ্ছেন। S-জিন ড্রপ আউট বৈশিষ্ট্যের কারণে জিনোম সিকোয়েন্স ছাড়াই আগের মতই সাধারণ আরটি-পিসিআর মেশিনের মাধ্যমে আক্রান্তকারীকে শনাক্ত করা যায়।

তবে ‘ওমিক্রন’ নিয়ে এখনো হাজারটা প্রশ্ন রয়েছে যার উত্তর বিভিন্ন গবেষনার মাধ্যমে পেতে অনেক সময় দরকার। তবে তার জন্য অপেক্ষায় না থেকে অনেকগুলি জরুরি পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য এক্ষুনি নেয়া দরকার। সর্বত্রই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা, অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি এগুলো মানার ব্যাপারে বিরামহীন প্রচার এবং কঠোর নজরদারি প্রণয়ন করা; বিমানবন্দর, সমুদ্র বন্দর এবং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ‘ওমিক্রন’ আক্রান্ত অন্যান্য ৮৯ টি দেশ থেকে আগত সকল যাত্রীদেরকে বাধ্যতামূলক আরটি-পিসিআর টেস্ট করা এবং প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা। ‘ওমিক্রন’ এ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হলে কন্টাক্ট ট্রেসিং করে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখা ও দক্ষিণ আফ্রিকা হতে গত এক মাসে ফেরত সকলকে কার্যকরী কোয়ারেন্টাইনে রাখাও অতি জরুরী।

‘ওমিক্রন’ বাংলাদেশে প্রবেশ করবে না কিংবা মহামারি আকারে দেখা দিবেনা এসব অমূলক চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে বরং ‘ওমিক্রন’ মহামারি আসবেই এবং তা ঠেকানো যাবে না তা ভেবেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া উচিত। মহামারি আসলে যেন তা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর না হয় এবং হসপিটাল ও হেলথকেয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যেন ভেঙে না পড়ে সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। করোনার সকল হাসপাতাল, নার্স, ডাক্তার, বয়, অক্সিজেন সাপ্লাই, আইসিইউ বেড, স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রীর পর্যাপ্ততা এবং প্রস্তুতি এক্ষুনি নিয়ে রাখতে হবে। টেস্টের সংখ্যা যেন অতি দ্রুত বৃদ্ধি করা যায় সে ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে হবে। প্রতিমাসে ৪ বা ৫ কোটি টিকা দিয়ে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে টার্গেট গ্রুপের সমস্ত লোককে প্রথম ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং এর মধ্যে টার্গেট গ্রুপের অন্তত ৫০ শতাংশ লোককে দ্বিতীয় ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব ১৩ মিলিয়ন কিংবা সম্ভব হলে পঞ্চাশোর্ধ ৩০ মিলিয়ন লোকের জন্য বুস্টার ডোজ এর ব্যবস্থা করতে হবে।

মানুষদের মধ্যে টিকা দিয়ে করোনাভাইরাস এর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যতটা সম্ভব বাড়ানো যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, ‘ওমিক্রন’ আসার প্রাক্কালে উন্নত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ এই মুহূর্তে বুস্টার ডোজ এর উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করছে। ‘ওমিক্রন’ ভেরিয়েন্টকে প্রতিরোধ করবার জন্য মডিফাইড ভ্যাকসিন এর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েও রাখছে তারা। আমাদেরও প্রয়োজন এইসব টিকার সংস্থান এবং মজুদের একটি কন্টিনজেন্সি প্লান তৈরি করে রাখা। সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পূর্ব প্রস্তুতিই পারে করোনার এই নতুন ধরনের আক্রমণের হাত থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখতে।

লেখক: শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

শেখ ফজলুল হক মনি: সৃজনশীল রাজনীতির পথপ্রদর্শক

সেই একটা সময় ছিল ত্যাগ-ব্রতের রাজনীতি, তাঁদের ঘিরে যারা জড়ো হতেন তাঁদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছিল। রাজনীতি চর্চার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ ছিল, চরিত্রে সংহতি ছিল। তাঁরা দেশের মানুষকে ভোটার বা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়িই শুধু ভাবতেন না, বড় করে দেখতেন। আমাদের মনি সাহেব ছিলেন এই দলের মানুষ। মনি ভাইকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম।’ কবি আসাদ চৌধুরীর এমন ভাবনার মাঝেই শেখ ফজলুল হক মনির ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের দর্শন ফুটে উঠেছে।

শেখ ফজলুল হক মনি, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি নাম, একটি ইতিহাস, যার হাত ধরে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যুব রাজনীতির বীজ রোপিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশের কল্যাণকামী যুবসমাজকে সাথে নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নেতৃত্ব গুণাবলী, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এদেশের যুব সমাজের আইকন। যিনি নিজ মেধায় হয়ে উঠেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশের যুব রাজনীতি ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নক্ষত্র, বহুগুণে গুণান্বিত এবং বিরল প্রতিভার অধিকারী শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম শেখ নূরুল হক বঙ্গবন্ধুর নিকটতম আত্মীয় এবং ভগ্নিপতি। মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর রাখায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বোন আছিয়া বেগমের কাছ থেকে শেখ মনিকে চেয়ে নেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর হাতেই রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের হাতেখড়ি হয় শেখ মনির।

১৯৬০-৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় তৎকালীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের জোরালো আন্দোলনে বলিষ্ঠ হাতে নেতৃত্ব দেন শেখ মনি। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেয়া শরীফ কমিশনের অগণতান্ত্রিক ও শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন।

শেখ ফজলুল হোক মনি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই অসীম সাহসী ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। আর একারণেই ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ফলশ্রুতিতে মোনায়েম খান ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেন। পরে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে তিনি তার অর্জিত ডিগ্রি ফিরে পান।

শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব বাংলার মুক্তির সনদ তথা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা পালন করা। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে সারাদেশ ব্যাপী হরতাল সফল করে তোলার অগ্রসেনানী ছিলেন শেখ মনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ওই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম হয়তো পিছিয়ে যেত। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে এ অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। এসময় বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ কারাবাস শেষে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান।

দেশ এবং দলের প্রয়োজনে যেকোনো ধরণের ত্যাগ স্বীকারের মূর্ত প্রতীক ছিলেন শেখ মনি। যার প্রমাণ মেলে ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের সময়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে এমপি হওয়ার সকল ধরণের সুযোগ এবং সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তিনি সারা দেশব্যাপী বৃহত্তর পরিসরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক- বীমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ শতাংশ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শেখ মনি।

৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে দেহ মাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন শেখ মনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের লক্ষ্যে দেশের মুক্তিকামী যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন মুজিব বাহিনী। তিনি ছিলেন উক্ত মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক।

শেখ ফজলুল হক মনি শুধুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, মনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল দার্শনিক, একজন প্রথিতযশা লেখক ও সাংবাদিক। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। শেখ মনি ছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। শেখ মনির লেখা ‘অবাঞ্ছিত’উপন্যাস পাঠক সমাজেও প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক।

রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখে স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন শেখ মনি। এর প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৭৫-এ জাতীয় ঐক্যের রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠনের পর শেখ ফজলুল হক মণি বাকশালের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে। ৭৫ এর ঘাতকরা খুব ভালোভাবেই তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলো বলেই ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার লক্ষ্যে পরিচালিত আক্রমণের প্রথম শিকার হন শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি। ঘাতকরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো শেখ মনি বেঁচে থাকলে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।

যতদিন পৃথিবীর আকাশে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়বে ততদিন এদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলার যুব রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ ফজলুল হক মনি। ব্যক্তি শেখ মনির মৃত্যু হলেও শেখ মনির স্বপ্নের যুবলীগ ও তাঁর আদর্শ চির অম্লান। বর্তমান যুবলীগের নেতৃত্বে থাকা শেখ মনির সুযোগ্য সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রতিচ্ছবি মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ শেখ মনির আদর্শ লালন করে তাঁর স্বপ্নের ‘অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

লেখক: শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

(দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত)

চীন সাগরে দ্বিপাক্ষিক সংঘাত ও তাইওয়ানের ভবিষ্যৎ

তাইওয়ান দক্ষিণ চীন সমুদ্রের একটি দ্বীপ যারা বিশ্বের ২০তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে স্বীকৃত এবং তাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত চীনের সংঘাতপূর্ণ অধ্যায়। চীনের বক্তব্য অনুযায়ী তাইওয়ান তাদের অংশ। যেটি ভবিষ্যতে কোনো একদিন চীনের সঙ্গে একীভূত হবে। তাইওয়ান নিজেকে কিভাবে দেখে? সেটার উত্তর অবশ্য এতটা সরল নয়। তাইওয়ান রাজনৈতিকভাবে চীনের অংশ নয়, কিন্তু আবার চীন থেকে আলাদাও নয়। বহু বছর ধরে চীন ও তাইওয়ানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র একটি অস্পষ্ট ও রহস্যময় নীতি অবলম্বন করে আসছে। এ নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা দেয়। কিন্তু, মার্কিন কর্তৃপক্ষ কখনো প্রকাশ্যে বলেনি যে চীনা আক্রমণের সময় তারা তাইওয়ানের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দুই বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক ও সংঘাত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্ব বহন করে।

চার দশক আগে, ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন – দুই পক্ষই তাইওয়ান নিয়ে পারস্পরিক বিরোধে না জড়াতে কূটনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে । তবে সেটা তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে হয়নি, হয়েছে দেশটির বাণিজ্যিক কূটকৌশল এবং সংখ্যালঘু জনগণের ওপর দমনপীড়নের কারণে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের কাছে সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ তাইওয়ান। চীন দ্বীপটির উপকূলে সেনা সমাবেশ ও সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি তাইওয়ানকে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা অব্যহত রাখছে । চীনের এ রকম শক্তি প্রদর্শনে তাইওয়ানের বড় ভরসা যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক কৌশল বিষয়টিকে আরো ঘোলাটে করছে। একদিকে তাদের আনুষ্ঠানিক নীতি হচ্ছে, তাইওয়ানে যদি কোনো অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটে-সেটা হতে হবে সম্মতিপূর্বক। আবার তারা এটাও বারবার করে বলে আসছে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন দেবে না। ছোট্ট একটি দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য এ রকম মহাশক্তিধর চীনকে মোকাবিলা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটা বাস্তবসম্মত তা একটি চিন্তার বিষয়ও বটে।

বর্তমানে তাইওয়ান যদি নিজ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে অথবা যুক্তরাষ্ট্র যদি তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়, তবে চীনের জন্য যুদ্ধ শুরু করা অত্যাবশ্যক বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হওয়া উচিত আগের বিষয়টাকে স্তিমিত করে দেওয়া, পরেরটা এড়িয়ে যাওয়া।

বিশ্বের অনেক দেশের মধ্যেই আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক মতবিরোধ আছে। অনেক মতবিরোধ শত বছর ধরেও চলে আসছে। তাইওয়ানের পরিস্থিতিও বিশ্বমোড়লদের রাজনৈতিক মতবিরোধের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই পরিস্থিতিকে জিইয়ে না রেখে সমাধানযোগ্য বিষয় হিসাবে পর্যালোচনা করা উচিত। সেখানকার পরিস্থিতি যদি কোনোভাবে সংঘাতের দিকে গড়ায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, চীনতো বটেই; অত্র অঞ্চলের অন্যান্য দেশ এবং বাকি বিশ্বের জন্যও তা ভয়াবহ হবে।

লেখক: শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

(দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত)

A Statement from a Steadfast Leader: PM Hasina’s address to the 76th UNGA session

Honourable Prime Minister of Bangladesh Sheikh Hasina has addressed the UN General Assembly on September 25, 2021, She initiated her speech by saying, “On the momentous occasion of the United Nations’ 76th anniversary, Bangladesh joins the world community in reaffirming its steadfast commitment to the United Nations Charter’s Purposes and Principles. The United Nations has championed human progress on many fronts during the last 76 years including, peace and security, human rights, decolonization, women’s empowerment, sustainable development, and so on”.

In her address, she deliberated on six major contingencies the world is currently facing. Current situation of the Rohingyas in Bangladesh, the post-COVID 19 scenario worldwide, Vaccine divide, collapse of global education system due pandemic, ‘Mujib Climate Prosperity Plan – Decade 2030’ to address climate vulnerability, Bangladesh’s graduating out from LDC, Bangladesh’s contribution to UN peace keeping effort and Bangladesh’s joining of peaceful nuclear club.

Prime Minister Sheikh Hasina has presented proposals to world leaders to combat the deadly virus with new, inclusive, and efficient manner, referring to Covid-19 as a common enemy. She stated, “Unfortunately, this ailment appears to be here to stay, and we must, like in the past, come up with new, inclusive, and worldwide solutions to combat this common enemy. I’d like to draw attention to a few specific difficulties in this regard.”

Sheikh Hasina stated in her first proposal for a Covid-free future and said that “We must ensure ubiquitous and affordable access to vaccines for people around the world,” According to the World Bank, 84 percent of vaccination doses have been distributed to people in rich and higher middle-income countries so far, while low-income nations have gotten less than 1%. She stated that the immunization disparity must be addressed immediately. We can’t plan a long-term recovery and be safe if we leave millions of people behind.” She also suggested that transferring vaccination innovations rapidly could help assure vaccine fairness. She stated that Bangladesh is ready to produce vaccines on a large scale if technical know-how is shared and patent waivers are allowed. Hasina stated at the United Nations General Assembly that Covid-19 vaccinations should be treated as a “global public good.” Many other leaders mirrored this sentiment earlier. However, these pleas have mostly gone unheeded. Instead, we’ve witnessed an increase in ‘vaccine divides’ between affluent and poor countries.”

In her second proposal, PM Sheikh Hasina claimed that the epidemic has disproportionately impacted climate-vulnerable countries. She noted the climate change issue and stated that climate change’s terrible effects will be permanent unless prompt action is taken. No country, wealthy or impoverished, is immune to the negative consequences. Therefore she urged developed and developing countries to reduce carbon emissions, pay for losses and damages, and provide enough funding and technology transfer for adaptation and resilience development. She expressed her belief that the upcoming COP-26 Summit in Glasgow would be an excellent venue for rallying support for such innovative and inclusive proposals. As the chair of the Climate Vulnerable Forum and the Vulnerable Twenty Group of Finance Ministers; she added that Bangladesh has announced the  while establishing a transformative plan from climate vulnerability to climate prosperity.

As she moved to the third issue, she highlighted the sudden collapse of the educational institutions all over the world due to the COVID-19 situation. She stated that the pandemic had seriously interrupted the education system and that millions of students in low-income nations lacked the resources and technology to participate in remote learning facilities, jeopardizing decades of enrolment and literacy progress.  She also added, “We need a worldwide strategy that prioritizes education recovery by investing in digital tools and services, internet access, and teacher capacity building. We also call on the UN system to rally support and resources to achieve this goal.” Covid-19, according to the prime minister, has shown the weakness of the global response to catastrophes. It has also brought attention to the necessity for global solidarity and collaboration to respond effectively to Covid-19.

Despite the difficult obstacles provided by the Covid-19 outbreak, Hasina stated that Bangladesh is on pace to graduate from the LDC designation. The Covid-19 pandemic, on the other hand, has jeopardized several countries’ graduation prospects and ambitions. Bangladesh looks forward to getting more help from our development partners for an incentive-based graduation system to inspire and incentivize sustained graduation. Bangladesh expects meaningful outcomes from the Doha conference, she said, as one of the co-chairs of the Preparatory Committee for the LDC 5 Conference. This will allow more countries to sustainably graduate out of the LDC designation.

The prime minister stated in her fifth proposal that migrants were frontline contributors during the pandemic as critical employees in health and other emergency services. However, many of them have been disproportionately harmed as a result of job losses, wage reduction, lack of access to health and other social services, and compulsory return. She also said to treat the immigrants as more humanely as possible so that they can feel their worth as resourceful human beings and can repay the hosting country with their knowledge and efforts. Bangladesh’s foreign policy, she said, continues to prioritize peace. Bangladesh remains deeply dedicated to establishing a peaceful society as a supporter of the Culture of Peace resolution. In many regions of the world, the threat of terrorism and violent extremism is jeopardizing peace and security. As a result, Bangladesh’s government maintains a “zero-tolerance policy” regarding terrorist threats. She spoke about Bangladesh’s peacekeeping assignments, saying that despite the pandemic’s unprecedented obstacles, peacekeepers are working in some of the world’s most difficult situations with the utmost dedication and professionalism. She stated that the world community must take all necessary steps to secure their safety and security.

The PM stated in her last proposal that the Rohingya situation is now in its fifth year. Despite this, not a single forcefully displaced Myanmar nationals has been able to return home. Despite the uncertainties produced by recent political developments in Myanmar, Bangladesh anticipates increased international emphasis and active support in finding a long-term solution to this situation. Myanmar, she said, must establish the right conditions for them to return. Bangladesh’s government is well prepared to collaborate with the world community on this critical issue. She further stated that Bangladesh had moved some of the forcefully displaced Myanmar citizens to ‘Bhasan Char’ in order to assure their temporary stay in Bangladesh.

Sheikh Hasina also stated that the international community must engage constructively to find a long-term solution to the issue by ensuring the Rohingyas’ safe, sustainable, and dignified return to Rakhine State. While the government of Bangladesh anticipates the ASEAN leadership to continue their efforts, the international community must back all accountability mechanisms. The PM has expressed her desire for a peaceful, stable, and prosperous South Asia. On Afghanistan, she said that it is the responsibility of the Afghan people to rebuild their nation and determine their own future. Bangladesh is willing to continue collaborating with the Afghan people and the international community on the country’s socio-economic development.

As Bangladesh is gradually becoming a country that uses nuclear energy for electricity generation, she stated her concern on the proliferation of nuclear weapons. Regarding the nuclear disarmament, she stated that, as enshrined in its constitution, Bangladesh has always been a staunch supporter of complete nuclear disarmament. She said that the total elimination of nuclear weapons and other weapons of mass destruction is the ultimate guarantor of international peace and security. Based on that conviction, Bangladesh government ratified the Treaty on the Prohibition of Nuclear Weapons (TPNW), which went into effect earlier this year.

Bangladesh, she continued, has established a brand name in UN peacekeeping operations as a strong proponent of the “Culture of Peace.” Bangladesh has shown outstanding achievements in executing the Sustainable Development Goals, ensuring food security, empowering women, scaling up people-centric development programs, and embracing new solutions for stable growth are well known,” she said. Therefore, despite the onslaughts of the Covid-19 pandemic, Bangladesh is on course to become a middle-income country by 2021, a developed country by 2041, and a prosperous Delta by 2100.

 

Sheikh Mohammad Fauzul Mubin

Member, Central Committee

Bangladesh Awami Jubo League

(Previously published in the international magazine ‘Diplomats World‘)

আশীর্বাদের কপালে অভিশাপের কলঙ্ক

দেশের ক্রমবর্ধমান ইন্টারনেট সেবা ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও অনলাইনে গুজব, হয়রানি ও উসকানিমূলক সংবাদ ও বক্তব্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ সরকারের ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ ২০১৮ সালে মন্ত্রীপরিষদে অনুমোদিত হয়। কিন্তু বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো বরাবরই সরকারকে সমালোচিত করার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে এই আইনকে। ফলে সমাজের সাধারণ মানুষের ডিজিটাল নিরাপত্তার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই আইন এখন বাক স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হিসেবেই সর্বত্র আলোচিত সমালোচিত হচ্ছে। কিন্তু এই আইনটি যদি না থাকত বা আজ এই মুহূর্তেই যদি এই আইনকে বাতিল ঘোষণা করা হয় তাহলে এর ফলাফল কী দাঁড়াবে তা নিয়ে সচেতন মহলের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তাই আসুন, শুধুই প্রদীপের নিচের অন্ধকারকে দিকে তাকিয়ে না থেকে নজর একটু উপরে উঠিয়ে এর আলোকিত দিকটি নিয়ে একটু পর্যালোচনা করি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ১২ অক্টোবর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কৃষক দলের বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘বিএনপির মধ্যে গণতন্ত্র নেই’ এমন বক্তব্যের জবাবে বলেন, ‘তাঁর কথায় ঘোড়াও হাসে’। তিনি আবারও ২৬ অক্টোবর দৈনিক সমকাল-এ একটি কলাম নিবন্ধে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখনও গণতন্ত্রের জন্য, ভোটাধিকারের জন্য লড়তে হচ্ছে। বাক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার আর ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশে যদি বাক স্বাধীনতা নাই থাকে তাহলে তিনি এরূপ সত্য-মিথ্যার মিশেলে ও মানহানিকর বিবৃতি দেওয়ার সুযোগ পান কীভাবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল ৭/৮ বছর ধরে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর টকশোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছেন। বিবিসি-তে দেওয়া তার এক বিবৃতি অনুযায়ী, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার বাক স্বাধীনতার ওপর আঘাত করছে। তিনি আরও বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় সামাজিক নেটওয়ার্কে বা এর বাইরে কারও মন্তব্য নিয়ে যে কোন অজুহাতে তাকে আটক করে রাখা যায় এবং অহরহ এ ধরণের ঘটছে।’
কিন্তু তা সত্ত্বেও টকশোগুলোতে তার সরব উপস্থিতি কী এটাই প্রমাণ করে না যে বাংলাদেশে বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের সুযোগ আছে এবং তিনি সেই সুযোগের সুফল ভোগ করে রীতিমত টকশো তারকা হয়ে নিঃশঙ্ক চিত্তে সরকারের সমালোচনা করতে পারছেন?
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘দেশে করোনার সংক্রমণের মরণ ছোবলে মানুষ যখন ভীত ও উদ্বিগ্ন তখনও মানুষের মুখ বন্ধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার হিড়িক চলছে। বর্তমান নিপীড়নমূলক এই মামলা দেশের ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙেছে।‘ কিন্তু উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই যখন করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে সরকারের দূরদর্শিতা ও সদিচ্ছার ফলে অতি দ্রুতই দেশের সর্বস্তরে বিনামূল্যে করোনার টিকা দেয়া হচ্ছে। ওডাব্লিউআইডি- এর সমীক্ষা অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর, ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬ কোটি ৮ লক্ষ ৭১ হাজার ৬৮৪ ডোজ করোনা টিকা দেয়া হয়েছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬.৬%। এমনকি যেই মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টিকা প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল সেই রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও করোনার টিকা পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও সরকারের নামে এরূপ বিষোদগার করা অন্ধ বিরোধিতারই নামান্তর মাত্র।
বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বাক স্বাধীনতার প্রকৃত চিত্রটি বুঝতে গত এক মাস দেশী-বিদেশী টিভি চ্যানেল ও ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজের লাইভ সেশনগুলো একটু ফলোআপ করার চেষ্টা করলাম। লব্ধ অভিজ্ঞতাটি বলতে গেলে বেশ চমকপ্রদ ছিল। এই টকশো ও লাইভ সেশনগুলোতে বর্তমান সরকারকে যেরূপ অত্যাচারী ও নিপীড়নকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয় সেগুলো শুনলে মনে হয় দেশে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরশাসন চলছে, যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ঢালাও লুটপাট হচ্ছে, সরকার বিরোধী দলকে মেরে কেটে সাফ করে ফেলছে, বাক স্বাধীনতার কোন অস্তিত্বই বাংলাদেশে নেই। এইসব কথাজীবীদের মধ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, রুমিন ফারহানা, আসিফ নজরুল, ড. আকবর আলী খান, সাবেক ডাকসু ভিপি নূর প্রমুখ অন্যতম। উনাদের কাছ থেকে যুক্তিনির্ভর ও গঠনমূলক সমালোচনার কোন আশা করিনি বলে অতটা নিরাশ হইনি, কিন্তু তাদের অবাস্তব ও ভিত্তিহীন অভিযোগের ফুলঝুড়ি এবং মিথ্যার বেসাতি দেখলে অনুসন্ধিৎসু মন জানতে চায় যে, তাদের ভাষ্যমতে দেশে যদি বাকস্বাধীনতা না ই থাকে তাহলে এতদিন তো তাদের জেলের ভিতরেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা নিশ্চিন্ত চিত্তে গম্ভীর মুখ করে দিব্যি তাদের টকশো টকশো খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন সর্বত্র।
‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি’ এর সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, ২০২১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশের মোট ইন্টারনেট সুবিধাভোগী জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৫৪ লক্ষ ৬০ হাজার জন, যার মধ্যে আইএসপি ও পিএসটিএন মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫০ হাজার আর মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ৫৪ লক্ষ ১০ হাজার। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩০টি সাইবার ক্রাইমের মামলা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর সাইবার ক্রাইম ডিভিশনের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ডিএমপি’র ফেসবুক মেসেঞ্জার, ইমেইল ও হ্যালো সিটি অ্যাপের মাধ্যমে গত চার বছরে প্রায় ১৭,০০০ সাইবার ক্রাইমের অভিযোগ এসেছে। রাজধানী ঢাকাতেই সাইবার অপরাধের এই চিত্র থেকে পুরো দেশের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়।
এই অপরাধগুলোকে আবার মোটা দাগে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। ধরুন একটি ছেলে ও মেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ব্রেকআপের পর ছেলেটি মেয়েটিকে আগে থেকে গোপনে ধারণ করা ছবি বা ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলো। আবার কোন ব্যবসায়ী ভুলবশত কোন ওয়েবলিঙ্কে বা অ্যাপে ক্লিক করে ফেলার ফলে তার ব্যাংক একাউন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস, সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট হ্যাক হয়ে গেল। আর বিকাশ বা অন্যান্য মোবাইল সেবায় ধোঁকাবাজি করে টাকা হাতিয়ে নেয়া, বিট কয়েন বা ভার্চুয়াল কারেন্সি দিয়ে ধোঁকাবাজি, ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে ধোঁকাবাজি প্রভৃতি তো অহরহই ঘটছে। এই অপরাধগুলোর সুবিধা হচ্ছে অপরাধী অনেক দূরে বসেও তার অপরাধ চালিয়ে যেতে পারে আর দক্ষতা বা পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সহজে তাদের নাগাল পায় না। এই ধরণের জঘন্য ও ধূর্ত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে শুধুমাত্র বিদ্যমান আইনই যথেষ্ট নয়, সেই সাথে প্রয়োজন আধুনিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট- এর ঢালাও সমালোচনা করার আগে এর খুঁটিনাটি সম্পর্কে সবারই ধারণা থাকা উচিত। কারণ গণতান্ত্রিক সরকারের যেকোনো আইন মূলত জনগণের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই প্রণয়ন করা হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টও এর ব্যতিক্রম নয়। এই আইনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে-
• ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জন শৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।
• আইনে অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এরকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
• কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের বিষয়েও বিধান রয়েছে এই আইনে। সেখানে ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম. কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ব্যাহত করে, এমন ডিজিটাল সন্ত্রাসী কাজের জন্য অপরাধী হবেন এবং এজন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
• ছবি বিকৃতি বা অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছেকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে কারো ব্যক্তিগত ছবি তোলা, প্রকাশ করা বা বিকৃত করা বা ধারণ করার মতো অপরাধ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ইন্টারনেটে পর্নগ্রাফি ও শিশু পর্নগ্রাফির অপরাধে সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• কোন ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া অনলাইন লেনদেন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
• বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বসে বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলেই তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে এর মধ্যে করা সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবস পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।
এরকম একটি সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করা বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যেকোনো তথ্য বা উপাত্ত যাচাই না করেই তা অনলাইনে প্রকাশের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো বা চরিত্রহনন করার অধিকার কারো নেই। শুধুমাত্র ভুল, মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে গণপিটুনিতে হত্যা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে মানহানি বা চরিত্রহনন করা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও তৎপরবর্তী বিশৃঙ্খলার মত ন্যক্কারজনক ঘটনা অতীতে বহুবার ঘটেছে। এর ফলে এক দিকে যেমন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটে তেমনি জানমালসহ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই ডিজিটাল মাধ্যমে করা অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যায়ক্রমে নির্মূলের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে এর মাধ্যমে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি ও অপবাদমূলক কর্মকাণ্ডকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সকল ক্ষেত্রেই নারীরা সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিং এর শিকার হয়। এমনকি উন্নত দেশগুলোও এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের উত্যক্ত করা, আপত্তিকর ছবি, ভিডিও, মিম প্রভৃতি শেয়ার করে এক শ্রেণীর বিকারগ্রস্ত পুরুষ বিকৃত আনন্দ লাভ করে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ভুয়া একাউন্ট ব্যবহার করে এই ন্যক্কারজনক কাজগুলো করে থাকে, যার ফলে তাদের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ফলে এই ধরণের অসুস্থ মানসিকতার অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। কিন্তু আইনগত ব্যবস্থা নিতে অনীহা, অনিবন্ধিত মোবাইল ও সিম সংযোগের ব্যবহার ও সামাজিক সচেতনতার অভাবে এই ধরনের অপরাধগুলোকে এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগই এই সমস্যার প্রকৃত সমাধান দিতে পারে।
কিন্তু বিশ্বের কোন আইনই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা ও সচেতনতার অভাবে অনেক জনহিতৈষী আইনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। সময়োপযোগী এই আইনকে ঘিরে কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনা যেন ভবিষ্যতে না ঘটে সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। সেই সাথে ডিএমপি, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই, র‍্যাব সহ প্রতিটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিজস্ব সাইবার ক্রাইম ইউনিট চালু করতে হবে। কারণ সাইবার ক্রিমিনালদের সাথে পাল্লা দিতে হলে অধিক যোগ্যতা সম্পন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন করা অতীব জরুরী। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদপুষ্ট আমাদের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি অত্যাবশ্যকীয় আশীর্বাদ। স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর অপপ্রচারে অযথাই শঙ্কিত হয়ে আমরা যদি একে অভিশাপ মনে করি তাহলে দিন শেষে আমরাই ভুক্তভোগী হব।
লেখক: শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
(সময়ের আলো ও বাংলাদেশ টুডে’তে পূর্ব প্রকাশিত)

শেখ ফজলুল হক মনি: যুব রাজনীতির মুকুটবিহীন সম্রাট

“বুঁজি তোমার মনিকে আমারে দাও, ও রাজনীতি করুক।”

উপরোক্ত উক্তিটি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধু তাঁর মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগমের কাছে এভাবেই আবদার করে শেখ মনিকে রাজনীতির জন্য চেয়ে নেন। প্রসঙ্গত কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়াকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন তাঁর এই মেজো বোন শেখ আছিয়া বেগম ও তাঁর স্বামী শেখ নূরুল হক (শেখ মনির মা বাবা)। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শেখ মনির মামা হতেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর হাতেই রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের হাতেখড়ি হয় শেখ মনির। নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যিনি হয়ে উঠেন এদেশের যুবরাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ।

শেখ ফজলুল হক মনি ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে অনেক স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়েও শেখ মনির সাথে তাঁর আবেগঘন সম্পর্কের ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “ন্যাপের হালিম, ভাগ্নে মণি পুরানা হাজত থেকে তারা এসেছে। এক জেলে থাকি আমার ভাগ্নে আমার সাথে দেখা করতে পারে না। কি বিচার!”(কারাগারের রোজনামচা, পৃ.২০২)। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বেগম মুজিব, শেখ রেহেনা এবং শেখ রাসেল জেল গেটে জন্মদিনের কেক আর ফুল নিয়ে যান। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: “রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সাথে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও“ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২১০)।

শেখ ফজলুল হক মনি, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি নাম, একটি ইতিহাস, যার হাত ধরে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যুব রাজনীতির বীজ রোপিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশের কল্যাণকামী যুবসমাজকে সাথে নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নেতৃত্ব গুণাবলী, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এদেশের যুব সমাজের আইকন। যিনি নিজ মেধায় হয়ে উঠেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশের যুব রাজনীতি ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নক্ষত্র, বহুগুণে গুণান্বিত এবং বিরল প্রতিভার অধিকারী শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।

১৯৬০-৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় তৎকালীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের জোরালো আন্দোলনে বলিষ্ঠ হাতে নেতৃত্ব দেন শেখ মনি। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেয়া শরীফ কমিশনের অগণতান্ত্রিক ও শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন।

শেখ ফজলুল হক মনি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই অসীম সাহসী ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। আর একারণেই ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ফলশ্রুতিতে মোনায়েম খান ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি’র ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেন। পরে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে তিনি তার অর্জিত ডিগ্রি ফিরে পান।

শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব বাংলার মুক্তির সনদ তথা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা পালন করা। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে সারাদেশ ব্যাপী হরতাল সফল করে তোলার অগ্রসেনানী ছিলেন শেখ মনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ওই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম হয়তো পিছিয়ে যেত। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে এ অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। এসময় বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ কারাবাস শেষে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান।

দেশ এবং দলের প্রয়োজনে যেকোনো ধরণের ত্যাগ স্বীকারের মূর্ত প্রতীক ছিলেন শেখ মনি। যার প্রমাণ মেলে ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের সময়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে এমপি হওয়ার সকল ধরণের সুযোগ এবং সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তিনি সারা দেশব্যাপী বৃহত্তর পরিসরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক- বীমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ শতাংশ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শেখ মনি।

৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে দেশমাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন শেখ মনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের লক্ষ্যে দেশের মুক্তিকামী যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন মুজিব বাহিনী। তিনি ছিলেন উক্ত মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক।

শেখ ফজলুল হক মনি শুধুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, মনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল দার্শনিক, একজন প্রথিতযশা লেখক ও সাংবাদিক। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। শেখ মনি ছিলেন দৈনিক বাংলার বাণী’র প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। শেখ মনি’র লেখা ‘অবাঞ্ছিতা’উপন্যাস পাঠক সমাজেও প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক।

রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখে স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন শেখ মনি। এর প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৭৫-এ জাতীয় ঐক্যের রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠনের পর শেখ ফজলুল হক মণি বাকশালের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে। ৭৫ এর ঘাতকরা খুব ভালোভাবেই তা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলো বলেই ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার লক্ষ্যে পরিচালিত আক্রমণের প্রথম শিকার হন শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি। ঘাতকরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো শেখ মনি বেঁচে থাকলে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।

ক্ষণজন্মা এই মানুষটি এই ধরায় মাত্র ৩৬ বছরের এক জীবন নিয়ে এসেছিলেন, এই অল্প সময়ের মাঝেই তিনি দেশের জন্য রাজনীতি করেছেন, স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ যুব সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। শুধু তাই নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতেও নিজের ছাপ রেখে গেছেন গল্প প্রবন্ধ রচনা করে। ব্যক্তি শেখ মনির মৃত্যু হলেও শেখ মনি’র স্বপ্নের যুবলীগ ও তাঁর আদর্শ চির অম্লান। বর্তমান যুবলীগের নেতৃত্বে থাকা শেখ মনির সুযোগ্য সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রতিচ্ছবি মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ শেখ মনির আদর্শ লালন করে তাঁর স্বপ্নের “অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ” বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যুবলীগের হাত ধরেই পূর্ণতা পাবে শেখ মনি ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা, যুবলীগের ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই হোক মোদের পণ।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

প্রধানমন্ত্রীর ভিশন কক্সবাজার

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের জেলা কক্সবাজার। সমুদ্রবিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি এই কক্সবাজার। এক পাশে দিগন্তজুড়ে সমুদ্র আর সবুজ পাহাড়ের হাতছানি, অপর পাশে অবকাঠামোগত উন্নয়নযজ্ঞ। কক্সবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভিশনকে উপজীব্য করে ভবিষ্যতের পর্যটন মডেল বিনির্মাণের লক্ষ্যে বর্তমানে একযোগে ৭৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি, যা এক বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে সরকারের মোট বরাদ্দ দেয়া অর্থের দেড় গুণ।

অতীতে কক্সবাজার যেখানে ছিল কেবলই এক সাধারণ দেশীয় পর্যটন কেন্দ্র, সেই জেলাই এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় পর্যটন ও অর্থনীতির এক গেম চেঞ্জার হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। যে কক্সবাজার এতকাল ছিল পর্যটকদের অভিযোগে জর্জরিত, সেই কক্সবাজারই এখন কেবল দেশী নয়, বিদেশী পর্যটকদের কাছেও কাক্সিক্ষত গন্তব্যস্থল। কেবল স্থানীয় অবকাঠামোই নয়, কক্সবাজারের সঙ্গে সমান্তরালে গড়ে উঠছে দেশী, বিদেশী কানেক্টিভিটি। গভীর সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেললাইন, ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক ও বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ২৫টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে একযোগে, যা বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে কক্সবাজারের চেহারা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পর্যটনে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে, কক্সবাজার হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র। এই কর্মযজ্ঞ যেন পর্যটন রাজধানীর মানুষের দেখা দীর্ঘদিনের স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন।

প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন রূপরেখা অনুযায়ী, পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সিঙ্গাপুর, হংকংসহ দ্বীপভিত্তিক অর্থনৈতিক হাবগুলোর আদলে গড়ে তুলতে কক্সবাজার ঘিরে এই মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বর্তমান সরকার। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও রেল সংযোগ, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বৈদ্যুতিক হাব গড়ে তোলার কারণে কক্সবাজার এখন দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যটন পার্ক, যা মূলত শুরু হয় ২০০৯ সালে প্রণীত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার ও কুনমিং হয়ে এশিয়ান হাইওয়েতে সম্পৃক্ত হওয়াও সহজ হবে। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৪ ঘণ্টাই বিমান ওঠানামার ব্যবস্থা করতে লোকালাইজার, ভিওআর, জিপি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজারের রেল যোগাযোগ স্থাপনের কাজও চলমান রয়েছে। পাশাপাশি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে মহেশখালী ইকোনমিক জোন দ্বীপভিত্তিক বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপ নেবে।

কক্সবাজারের দুর্গম দ্বীপ মাতারবাড়িতে ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতার চারটি বিদ্যুত কেন্দ্র, ল্যান্ডবেজ এলএনজি টার্মিনাল এবং ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন স্থাপনসহ অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল কর্মযজ্ঞ অঞ্চলটিকে ইতোমধ্যেই জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মাতারবাড়িতে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খননযন্ত্র ‘ক্যাসিওপিয়া–ফাইভ’ দিয়ে বালু-মাটি খুঁড়ে লবণমাঠ খনন করে বানানো হয়েছে জাহাজ চলাচলের কৃত্রিম নৌপথ বা চ্যানেল।

এ ছাড়া একই উপজেলায় ১৪৯.৭৫ একর জমি নিয়ে আরেকটি মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন প্রকল্পের কাজ চলছে। বাংলাদেশের প্রধান আমদানিস্থল চীনসহ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যে মেলবন্ধনের নিয়ামক হয়ে উঠবে জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে হতে যাওয়া মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর।

অপর দিকে, দেশে বৃহৎ প্রকল্প মহেশখালী হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা মৌজার আওতায় ১৪১৪.৬৫ একর জমি নিয়ে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। একই উপজেলায় বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড ৮৩২০ মেগাওয়াট এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পও বাস্তবায়ন করবে। বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশাপাশি মহেশখালী ও পেকুয়া উপজেলার ১৩টি মৌজার আওতায় জিটিসিএল সংস্থার মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন প্রকল্প চলমান। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যিক বিনিয়োগ আর পর্যটন শিল্পে কক্সবাজারের অগ্রগতি এখন দৃশ্যমান।

প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত রূপরেখা অনুযায়ী কক্সবাজারে এ ছাড়াও যেসব প্রকল্প সমান্তরালে চলমান, তার মধ্যে রয়েছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোং বাংলাদেশ লিঃ-এর ১২০০ মে.ও. কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণ, মহেশখালী উপজেলাকে ডিজিটাল আইল্যান্ড ঘোষণা বাস্তবায়ন, রামু উপজেলায় হাইটেক পার্ক নির্মাণ, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) স্থাপন, জালিয়ারদ্বীপ স্পেশাল ট্যুরিস্ট জোন স্থাপন, কক্সবাজার শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম এবং ক্রিকেট কমপ্লেক্স নির্মাণ, জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন ইত্যাদিসহ আরও বেশকিছু প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা এবং সর্বক্ষণিক নজরদারিতে এসব প্রকল্প কেবল কাগুজে রূপে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং গতিশীল রয়েছে বাস্তবায়নের পথে।

তবে এতসব কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি কিছু অনাকাক্সিক্ষত কর্মকা- শঙ্কার মুখে ফেলে দিচ্ছে কক্সবাজারকে ঘিরে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুফল বয়ে আনাকে। কক্সবাজারকে ঘিরে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডের পাশাপাশি স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কক্সবাজারের যত্রতত্র অপরিকল্পিত স্থাপনা গড়ে তুলছে। এসব অপরিকল্পিত স্থাপনা একদিকে যেমন কক্সবাজারের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের অন্তরায় অন্যদিকে সরকারীভাবে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভারসাম্যও নষ্ট করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য কক্সবাজারের উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সরকারের বিভিন্ন স্থানীয় দফতর অফিসগুলোর কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই এসব অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজারকে ঘিরে সরকারের বিশদ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যেন কোনভাবেই কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিস্বার্থের কাছে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া অতীব জরুরী।

 

শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন

লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

 

রাজনীতির তামাশাঘর

এপ্রিল, ২০১৮ – কোটা সংস্কার আন্দোলন। মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ধোয়া তুলে আন্দোলন-অবরোধ করে দেশকে স্থবির করে দেয়া হল। যার ফলে ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকুরিতে সকল প্রকারের কোটা বাতিল করতে সরকার বাধ্য হল। কিন্তু এর ফলাফল আসলে কি দাঁড়ালো?

প্রেক্ষাপট ০১- যে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করলেন, দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে আত্মোৎসর্গ করলেন; তাদের অপরিসীম ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য রাষ্ট্র থেকে দেয়া কোটা সুবিধা চলে গেল। এদের মধ্যে অনেকেই হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, কিন্তু আজ তারা বঞ্চিত।

প্রেক্ষাপট ০২- একজন মহিলা যে তার পরিবার থেকে দূরে যেতে চায় না, যা কিনা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশও; তিনি তার বাবা-মার কাছে থেকে, তার পরিবারের কাছে থেকে চাকুরি করার অধিকার রাখে। কিন্তু নিজ এলাকায় চাকুরির কোটা তুলে দেয়ায় সেই মহিলা তার নিজ এলাকায় চাকুরি করার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হল।
প্রেক্ষাপট ০৩- আদিবাসীরা বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি। দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করার কারণে তারা অধিকাংশ মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। তাদের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে সরকার থেকে দেয়া আদিবাসী কোটার বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালানো শুরু হল। যার ফলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাওয়ার ও সমাজের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যেই সুযোগ ছিল তা থেকে আদিবাসীদের বঞ্চিত করা হল।

সকলের জন্য সমান অধিকার বা মেধা যাচাইয়ে সমান সুযোগের কথা যারা বলেন, তারা উপরোক্ত ঘটনাগুলোর মাধমে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার অলীক সুখ লাভ করতে পারেন। কিন্তু এখানে কিছু কথা না বললেই নয়। শুধু মেধাই সবসময় যথেষ্ট নয়, এর সাথে অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতাও ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। মেধা যাচাইয়ের সমান সুযোগ তখনই দাবি করা যায় যখন সমাজের সবাই সমপরিমাণ সুযোগ পায়। উদাহরণ স্বরূপ আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার কথাই ধরা যাক। শুধু ভালো বোলার বলেই কিন্তু তিনি জাতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পাননি। তার ক্রিকেট জ্ঞান ও দল চালানোর মত দক্ষতা এবং তা দীর্ঘসময় ধরে প্রমাণের সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই তিনি অধিনায়ক হতে পেরেছিলেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে আন্দোলনের ফলে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো তাদের অধিকার হারালো, সেই আন্দোলনকে সমান অধিকারের আন্দোলন বলা কতটুকু সমীচীন। কারণ এখন তাদের জন্য সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার কোন পরিবেশই আর রইলো না। তাই কোটা সংস্কার আন্দোলন সত্যিকার অর্থে বঞ্চিতদেরই বঞ্চিত করেছে। যারা এটা অস্বীকার করে সাম্যের জয়গান গাইবে তাদের মানসিক পরিপক্বতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেই হয়।

এবার ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ নিয়ে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে আলোকপাত করা যাক। স্কুলের দুইটি ছাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হল, সারা দেশের ছাত্র সমাজ বিচারের দাবিতে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ফেটে পড়লো, ফলশ্রুতিতে সকলের দাবি মেনে নিয়ে সরকার সড়ক আইন সংশোধন করতে বাধ্য হল। কিন্তু একটি গোষ্ঠি একেও তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে ব্যবহার করল। সচেতন ছাত্র সমাজের কাছ থেকে এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সুবিধাবাদীদের সরকার বিরোধী সমালোচনা ও আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হল। বরঞ্চ সড়ক ও জনপথের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য সরকার দেশব্যাপী যে বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করছে, যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করছে সেগুলোই মানুষের প্রকৃত উপকারে আসছে। কিন্তু এই দুই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখন একটি গোষ্ঠী একত্রিত হয়েছে, যারা তাদের পুরো সময়টাই ব্যয় করে সরকার ও আওয়ামী লীগের নামে সমালোচনা করে।

সরকারের কোন উন্নয়ন প্রকল্পের সাফল্যই তাদের চোখে পড়ে না, সরকারের সব কাজেই তারা ব্যর্থতা খুঁজে পায়। আর সরকারের বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন বা প্রশংসা করারতো কোন প্রশ্নই উঠে না। এইসব ভুঁইফোড় নেতাদের কোন রাজনৈতিক দর্শন নেই, জনগণের রাজনীতি করার মত মানসিক পরিপক্বতাও নেই। দেশের সর্বস্তরের মানুষের উন্নতির জন্য সামগ্রিকভাবে চিন্তা করার সামর্থ্য তো একেবারেই নেই। মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে আর পুঁথিগত বিদ্যার উপরে ভর করে তারা আজ রাজনৈতিক নেতা। আর তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান ক্ষেত্রই হচ্ছে ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’। বাংলাদেশের মানুষের সহজ-সরল আবেগকে পুঁজি করে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপরে ভর করে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনীতির এক ‘তামাশাঘর’ তৈরি করেছে।

মানুষকে রাজনৈতিক বিনোদন বা তামাশা প্রদানের মাধ্যমে তারা নিজেদের আজ জনমানুষের নেতা হিসেবে দাবি করে; যদিও দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে চলার, তাদের সুখ-দুঃখ, দাবি-দাওয়া বুঝতে পারার মত যোগ্যতাই তাদের নেই। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইক-কমেন্ট করে রাতারাতি প্রচুর ফলোয়ার বানানো যায়, কিন্তু মানুষের পাশে থেকে রাজনীতির যে অভিজ্ঞতা তা অর্জন করা যায় না।

এই দুই আন্দোলনের প্রকৃত সুফল পাচ্ছে সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূর ও তার গড়ে তোলা ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ’ এর উচ্চপদস্থ নেতারা। সম্প্রতি তারা বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ দলগুলোর সাথে টেক্কা দেয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক দল ‘গণ অধিকার পরিষদ’ চালু করেছে। এই ভিপি নূর ও তার সহযোগী রাশেদ খান, ফারুক হাসান, মশিউর রহমান, সোহরাব হোসেন, আবু হানিফ, মাহফুজুর রহমান – এইসব নেতাদের কারো বয়সই ৩০ পার হয় নি। এদের অপরিপক্ব বক্তব্য, বড়দের সাথে কথা বলায় আদবের অভাব, তাদের বিরুদ্ধে মাদক-নারীসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির নজির দেখলে আশংকা জাগে যে এরাই কি আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির কাণ্ডারি হতে যাচ্ছে কি না। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে ড. রেজা কিবরিয়া, যিনি রাজনৈতিক সুবিধার জন্য গণ ফোরাম-এর সাধারণ সম্পাদকের পদ ত্যাগ করে ভিপি নূরের ‘গণ অধিকার পরিষদ’ এ যোগদান করেছেন। এই ধরনের বসন্তের কোকিলের মত নেতা দিয়ে দেশ তো দূরের কথা, দলেরই উন্নয়ন হওয়া সম্ভব না। কারণ নিজেদের ফায়দার জন্য যারা নীতির বিসর্জন দেয়, তারা কিভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে?

তাদের মত অপরিপক্ব ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যহীন ভুঁইফোড় রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে কখনোই একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখা যায় না। সরকার, প্রশাসন বা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতৃবৃন্দের কাছে তাদের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনীতি রাজনীতি খেলার সময় বা সুযোগ কোনটাই নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হাজারো রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনের সাথে সরকারকে প্রতিনিয়তই যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের জন্য এইসব রাজনৈতিক ছেলেখেলায় অংশগ্রহণ করা মানায় না, তাদের এরূপ কিছু করার সুযোগও নেই। কিন্তু রঙিন চশমা চোখে দিয়ে ঘরে বসে রাজনৈতিক বিনোদন উপোভোগ করা তথাকথিত সুশীল নাগরিক গোষ্ঠি যারা নূর-রাশেদ-ফারুক-মশিউর এদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছেন, আপনাদের ধারণাও নেই আপনারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে কোন অন্ধকার যুগের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে তাদের হাতেই দিতে হবে যারা মানসিকভাবে পরিপক্ব, যাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আছে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। যারা বিভিন্ন বিপদে বাংলাদেশকে দেখেছে, বিভিন্ন দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। যারা বাংলাদেশকে শুধু নোয়াখালী বা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখে না। যারা বাংলাদেশকে সমগ্র বিশ্বের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে, একটি সমগ্র জাতি হিসেবে দেখতে পারে এরকম দলই আমাদের দরকার। কিন্তু তা না করে আমরা যদি অপরিপক্ব, অবিবেচক নেতৃত্বের কাছে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতকে সমর্পণ করি তাহলে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যাবে তা ভাবতেও ভয় হয়।

গত ১২ বছরে বাংলাদেশের যেই অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে তা সমগ্র বিশ্বের কাছেই বিস্ময়কর। কিন্তু এইসব ভুঁইফোড় নেতাদের কাছে একবার ক্ষমতা গেলে বাংলাদেশের যে দুর্বার অগ্রগতি হচ্ছে, যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হচ্ছে তা অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সর্বোপরি তারা বাংলাদেশে উন্নতির যে যাত্রা শুরু হয়েছে তাকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। দেশের যুব সমাজকে ভুল পথে পরিচালিত করে তাদেরকে রাজনীতির ভুল তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা শিখাবে। সেই সাথে তরুণদের অনুপ্রেরণা ও কর্মস্পৃহাকে ক্ষুন্ন করে এমন একটি বিভাজন তৈরি করবে যা সমগ্র জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই এদের দুরভিসন্ধির ব্যাপারে আমাদের এখন থেকেই সতর্ক থাকা অতীব জরুরি।

লেখক : শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন

সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

১৭ আগস্ট কথন: জঙ্গিবাদ যেন বাংলাদেশে আর মাথাচাড়া না দেয়

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে টিকে থাকা এই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রতি বিএনপি’র পক্ষপাতিত্ব চোখে লাগার মতো ছিল। এর খেসারতও পরবর্তী সময়ে বিএনপিকেই দিতে হয়েছিল। যদিও সে সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ভাষ্যমতে এই ঘটনার পিছনে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হাত আছে বলে তাদের কাছে তথ্য আছে বলে জানা যায়।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট, বুধবার। সপ্তাহের অন্য ব্যস্ততম কার্যদিবসগুলোর মতো এ দিনটিও শুরু হয়েছিল কর্মব্যস্ততায়। আলী করিম সাহেব তার ছেলে আরেফিনকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাবেন। তার স্ত্রী আফরোজা করিম তার অসুস্থ মাকে দেখতে হসপিটালের দিকে রওনা হয়েছেন। মাকে দেখে আবার আরেফিনকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে। কিন্তু হসপিটাল থেকে সাড়ে ১১টার দিকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ দেখেন চারদিকে হুড়োহুড়ি। সারা দেশে নাকি বোমা হামলা হয়েছে। কারা করেছে, কেন করেছে, এখনও জানা যায়নি। করিম সাহেব অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই এই খবর শুনে ঘাবড়ে গিয়েছেন। অফিসের ফোন থেকে বার বার বাসায় কল দিচ্ছেন, কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। এ দিকে আরেফিনের স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু মা এখনও আসছে না। চারদিকে চিৎকার-কান্নাকাটি, এ যেন ২৫ মার্চের কালরাতেরই পুনরাবৃত্তি।

দিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র আধাঘণ্টায় একটি দেশের জনজীবন যেন থমকে গিয়েছিল। ওই দিন বাংলাদেশের ৬৩ জেলার ৩০০টি জায়গায় প্রায় ৫০০ সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল। নিহত হয়েছিলেন দুজন নিরীহ সাধারণ মানুষ, আহত হয়েছিলেন প্রায় ১৫০ জন। পুলিশ-বিডিআরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজর এড়িয়ে এত সুসংগঠিত আক্রমণ সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল।

প্রাথমিকভাবে এই ঘটনার দায় কেউ স্বীকার না করলেও পরবর্তী সময়ে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এই বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছিল। শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমানের (বাংলাভাই) নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীটি আল কায়েদার সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে হরকাত-উল-জিহাদ আল-ইসলাম (হুজি) নামের আরেকটি ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জেএমবির সঙ্গে এ ঘটনায় যুক্ত ছিল বলে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা যায়।

২০০১ সালের শেষের দিকেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম পরিপূর্ণরূপে সংগঠিত এবং জঙ্গিরীতিতে আক্রমণের ঘটনা ঘটা শুরু হয়। বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তাদের ধর্মীয় অনুভূতি, আর্থিক অসচ্ছলতা ও ধর্মীয় নির্দেশনার ভুল ব্যাখ্যাকে পুঁজি করে মৌলবাদী জঙ্গি দলগুলো বাংলাদেশে তাদের ঘাঁটি গাড়া শুরু করে। বিশেষ করে, তালেবান ও আল কায়েদাদের সঙ্গে এ সব মৌলবাদী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রচুর আর্থিক ও লজিস্টিক সাহায্যপ্রাপ্ত এই জঙ্গি সংগঠনগুলো বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের তরুণ জনশক্তির মগজধোলাই করে তাদের বিপথগামী করার চেষ্টারত ছিল। আর চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ মদদে দেশের মাদ্রাসাগুলোর ওপরে ভর করে তারা সফলভাবে সমাজের গভীরে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল।

২০০৫ সালের ২২ আগস্ট এক ওয়েব পোস্টে জেএমবি বাংলাদেশে ইসলামী শাসনের আহ্বান জানিয়ে বলেছিল যে, তারা শুধু আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সমাজব্যবস্থা দেখতে চায় এবং বাংলাদেশ সরকার যদি ইসলামের আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের দমন করার চেষ্টা করে তবে তারা সরাসরি পদক্ষেপ নেবে বলে সতর্ক করে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকীয়তে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র সমালোচনা করে। সাউথ এশিয়া ইন্টেলিজেন্স রিভিউতে বিশিষ্ট জঙ্গিবিরোধী লেখক ও গবেষক অজয় সাহানি লিখেছিলেন-“এই ধরনের একটি ষড়যন্ত্র গোয়েন্দা সংস্থার কারোরই নজরে পড়েনি, তা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।”

আওয়ামী লীগপ্রধান ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি ও চারদলীয় জোটকে বোমা হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন। হামলার পরে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি জোটের অন্তর্ভুক্ত রক্ষণশীল দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলকে দমন করতে দেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে আসছে। আর এরই প্রভাবে সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলার মতো একটি অকল্পনীয় ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে টিকে থাকা এই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রতি বিএনপি’র পক্ষপাতিত্ব চোখে লাগার মতো ছিল। এর খেসারতও পরবর্তী সময়ে বিএনপিকেই দিতে হয়েছিল। যদিও সে সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ভাষ্যমতে এই ঘটনার পিছনে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হাত আছে বলে তাদের কাছে তথ্য আছে বলে জানা যায়।

২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট যখন সরকার গঠন করেছিল, তখন হয়ত কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি যে, বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা কতটুকু বিস্তার লাভ করতে পারে। যে দেশের স্বাধীনতার অন্যতম মূল স্তম্ভই ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা, সেই দেশে ৬৩ জেলাজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা যেন এক অবাস্তব দুঃস্বপ্ন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এটাই অনস্বীকার্য বাস্তবতা, যেই বাস্তবতার ঘানি দেশকে টানতে হয়েছিল অনেক বছর।

এই ঘটনার পর সারা দেশে মোট ১৫৯টি মামলা হয়েছিল, যার মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ১৮টি মামলা হয়। ১৪২টি চার্জশিটে পুলিশ ১,০৭২ জনের নাম দেয়, যার মধ্যে ১৩৩ জন জামিনে আছে। ২০০৬ সালে র‌্যাবের বিশেষ কমান্ডো অভিযানে জেএমবির শীর্ষনেতা শায়খ আবদুর রহমান, তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, থিংক ট্যাঙ্ক আব্দুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ এবং সালাহউদ্দিনকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ২০০৭ সালের মার্চে আদালতের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

মূলত চারদলীয় জোট সরকারের বিচারহীনতার সংস্কৃতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বাস্তবিক অর্থে তাদের এহেন অপচর্চাই ওই অপশক্তি তথা জঙ্গিবাদকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সাহায্য করে। তৎকালীন সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাদের এই কার্যক্রমের ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল, যার মূল লক্ষ্যই ছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের বা পক্ষান্তরে চারদলীয় জোট সরকারের হারানো গ্রহণযোগ্যতাকে পুনরুদ্ধার করা।

যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ বিশ্লেষক ও জঙ্গিবাদ সমালোচকরা চরমপন্থার বিরুদ্ধে সরকারের অকার্যকরতার তীব্র সমালোচনা করেছিল এবং সমস্যার মূলে আঘাত না করে শুধু লোক দেখানো গ্রেপ্তার বা ফাঁসি দেয়া যে বাংলাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠীর ওপর সামান্যই প্রভাব ফেলবে এই ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। তাদের এই উদ্বেগ পরবর্তীকালে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।

২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। আর এই বিস্তারের পিছনে অন্যতম অনুঘটক ও পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করে চারদলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। তারা বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্য করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেছিল। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা থেকে শুরু করে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দমন পীড়নমূলক আচরণ ছিল তখনকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আর এই আক্রমণগুলো মূলত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোই গোপনে পরিচালনা করত।

এই উগ্র মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমের ফলেই আল কায়েদা হতে অনুদানপ্রাপ্ত ও অনুপ্রাণিত সন্ত্রাসী দলগুলো বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ পায়। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর তখন পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। এছাড়াও দেশের একটি বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী ভারতকে বাংলাদেশের উন্নতি ও ইসলামি পদ্ধতিতে সমাজ ব্যবস্থা প্রচলনের ক্ষেত্রে মূল অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করত। তাই তাদের কাছে ভারতবিদ্বেষ করার মাধ্যমে ইসলামিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করার এক ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাস চালু ছিল। এই উগ্রবাদিতার চর্চাই ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করেছিল।

অবশ্য চারদলীয় জোট সরকারের অনাচার ও সরকার পরিচালনায় অদক্ষতা থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে ২০০৯ থেকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারও ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু থেকেই সচেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। এরই ফলে বর্তমান সরকার স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’-এর ১৯৭১ সালে করা মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।

সরকারের এই সাফল্যগুলো কিন্তু রাতারাতি নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে রয়েছে। বিশেষ করে, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের জন্য নিরাপদ আস্তানা হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। সেই নীতি অনুসারে, তারা ২০০৯ সালে একটি ১৭ সদস্যের ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় কমিটি’ গঠন করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও নিরাপত্তা সংস্থার প্রতিনিধিরা।

কমিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবিলা করা এবং এই ধরনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার চারটি চরমপন্থি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাত-উল-জিহাদ আল ইসলামী (হুজিবি), হিযবুত তাহরীর (এইচটি) এবং শাহাদাত-ই-আল হিকমাকে নিষিদ্ধ করেছে। এই পরিচিত দলগুলো ছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কমিটির মাধ্যমে মনোনীত সকল সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

২০০৯ সালের জুলাইয়ে সরকার বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা কার্যক্রমের সমন্বয় সাধনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আট সদস্যের একটি ‘জাতীয় গোয়েন্দা সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে। কমিটিকে আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে তথ্যবিনিময়ের মাধ্যমে চরমপন্থার বিরুদ্ধে অভিযানকে আরও জোরদার করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের অর্থায়ন চিহ্নিত করা এবং অর্থের উৎস ও গতিবিধি নজরদারি করে মূল অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্যে সরকার ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট প্রণয়ন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।

২০১০ সালে সরকার একটি শক্তিশালী জঙ্গিবাদ বিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যা মাদ্রাসা পাঠ্যক্রম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। সরকার অ্যাকাডেমিক পাঠ্য বইয়ে উগ্রবাদবিরোধী অধ্যায়ও চালু করেছে। উপরন্তু, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করে আসছে। ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক ব্যাহত করার জন্য প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এছাড়াও, বাংলাদেশ এবং ভারত একটি সমন্বিত বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (CBMP) বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে এবং দুই দেশের সীমান্তে সন্ত্রাসসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধ করার লক্ষ্যে যৌথ টহলদারির সংখ্যা বাড়াতে সম্মত হয়েছে।

বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর সন্ত্রাস দমনে পারস্পরিক সহযোগিতা, দক্ষতা উন্নয়ন, তথ্যবিনিময় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দক্ষতা বিনিময়ের উদ্দেশ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিতের লক্ষ্যে সার্কভুক্ত দেশগুলোকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে কাজ করতে আহবান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ২০১৪ সালের ২০ মে Conference on Interaction and Confidence Building Measures in Asia (CICA)-এর পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে যাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এশিয়া মহাদেশের শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা করা।

বাংলাদেশ ধীরে হলেও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কালো থাবা থেকে দেশের মানুষ, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষত, আওয়ামী লীগ সরকার গত একযুগে জঙ্গিবাদের করাল থাবা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা প্রশংসার দাবিদার। আর ধর্মীয় সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োচিত সিদ্ধান্তগুলো উন্নত দেশগুলোর রাষ্ট্রনেতাদের কাছে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলার স্বপ্ন আজ এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

ব্যবসায় গণতন্ত্র :প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা

বর্তমানে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই ব্যবসাবাণিজ্যের অংশগ্রহণের যে সাম্যাবস্থা বিরাজ করছে তা কি একদিনে এসেছে? বেশি দিন নয়, ১ যুগ আগেও একটি সরকারি কাজে দরপত্র জমা দিতে বা সামান্য ট্রেড লাইসেন্স করতে গিয়ে যে পরিমাণ ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি প্রভৃতি সমস্যা সহ্য করতে হতো, আজকে কোনো ব্যবসায়ীকে সেসব সমস্যার কিয়দংশও কি সম্মুখীন হতে হয়? এই প্রশ্নগুলো কেউ সাধারণত করে না। বিশেষ করে আজকের তথাকথিত সুশীল সমাজ এ ব্যাপারে অদ্ভুতভাবে একপেশে, ক্ষেত্রবিশেষে এক চোখ বন্ধও করে রাখে। সরকারি কোনো প্রকল্পে বিন্দুমাত্র ত্রম্নটি বিচু্যতির খবর পেলেই যেভাবে সরকারের সমালোচনা করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তা শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, বরঞ্চ সন্দেহজনকও বটে। অথচ বাস্তবতা ও যৌক্তিক পরিসংখ্যানের নিরিখে সরকারের সমালোচনা না করে বিদ্বেষমূলক বিষোদ্গার করাটাই আজকাল কিছু বিশিষ্ট গবেষকদের আসল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের যে কোনো আংশিক বা প্রত্যাশাতীত সাফল্য স্বীকার করে নিতে তারা যেন বিশেষভাবে কুণ্ঠাবোধ করেন। চলুন আজ অন্তত অতীত পরিস্থিতির আলোকে বর্তমান অবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যাক।

প্রথমেই টেন্ডার দিয়ে শুরু করা যাক। টেন্ডার নিয়ে কথা বলতে গেলেই টেন্ডারবাজি শব্দটি আপনা আপনি চলে আসে। টেন্ডারবাজদের দৌরাত্ম্যের খবর আগে পত্রপত্রিকায় নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। টেন্ডার দিতে বাধা প্রদান, টেন্ডার বাক্স ছিনতাইসহ খুনোখুনির ঘটনাও ঘটতো টেন্ডার নিয়ে। সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের কবল থেকে সরকারি খাতের এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২ জুন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ইমপিস্নমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএমই) বিভাগের অধীনে ই-টেন্ডার ব্যবস্থা তথা ই-জিপি চালু করেন, যার বাস্তবায়ন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)। ই-জিপি’র ফলে সব পাবলিক প্রকিউরিং এজেন্সি ও পাবলিক প্রকিউরিং এন্টিটিগুলো একটি নির্দিষ্ট অনলাইন পস্ন্যাটফর্মে সরকারি টেন্ডারের সব কার্যক্রম সম্পাদন করার সুযোগ পায়। যেহেতু এই ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ অনলাইনে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটার দ্বারা মনিটর করা হয়ে থাকে, তাই ঘুষ বা দুর্নীতির সুযোগ নেই বললেই চলে।

এখানে আরো উলেস্নখ্য যে, সরকার শুধু সিস্টেম চালু করেই বসে থাকেনি, এর নিরবচ্ছিন্ন পরিচালনা ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার দিকেও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ই-জিপি সিস্টেম পরিচালনার জন্য সিপিটিইউ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে স্থাপন করা হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডাটা সেন্টার। বর্তমানে ই-জিপি সিস্টেমে মোট নিবন্ধিত দরদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৮ হাজার ২৪০, যার মধ্যে ৩৩টি আন্তর্জাতিক দরদাতাও নিবন্ধিত আছে। এছাড়াও ই-জিপিতে ১২টি আন্তর্জাতিক সংগঠনও উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে নিবন্ধিত আছে। ৪৮টি নিবন্ধিত ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে দেশব্যাপী ই-জিপি পেমেন্ট অনলাইন ও অফলাইন দু’ভাবেই নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার যথাসম্ভব নিখুঁতভাবে এমন একটি ডিজিটাল প্রকিউরমেন্ট পস্ন্যাটফরম তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে যার সুফল ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ভোগ করতে পারবে।

বর্তমানে সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোর পাবলিক প্রকিউরিংয়ের প্রক্রিয়াগুলি যেমন: কাজের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা এবং জমা দেওয়া, মাইলফলক নির্ধারণ, প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, প্রতিবেদন তৈরি করা, কাজের মান নিয়ন্ত্রণ করা, বিল তৈরি করা, ভেন্ডর রেটিং এবং প্রকল্প সমাপ্তির প্রশংসাপত্র প্রদান ইত্যাদি সবই এখন ই-জিপি’র মাধ্যমেই করা সম্ভব। আগে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন অনুযায়ী সরকারি ক্রয়াদেশ ও দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য কিছু অসাধু সরকারি কর্মচারী তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য পরিচিত প্রাইভেট কন্ট্রাক্টরদের দিয়ে ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নিত। কিন্তুপ্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ই-জিপি’র মাধ্যমে ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট পদ্ধতিকে সীমিত করে ওপেন টেন্ডারিং মেথড, লিমিটেড টেন্ডারিং মেথড ইত্যাদি যুগোপযোগী পদ্ধতির সুষ্ঠু প্রয়োগ করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা অনুযায়ী যে কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একবারের বেশি কোনোভাবেই চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না। এতে একদিকে যেমন সরকারি প্রকল্পগুলো সুদক্ষভাবে ও সঠিক সময়েই সম্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে, সেই সঙ্গে সরকারি প্রকল্পগুলোর কন্ট্রাক্টরদের একই মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে বারবার টেন্ডার পাওয়ার সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেট গঠনের সম্ভাবনাও বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

বর্তমানে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত পূর্ত ক্রয় কার্যক্রম ই-জিপি সিস্টেমে করা হচ্ছে। ফলে দরদাতাকে এখন আর অফিসে ধর্ণা দিতে হয় না। টেন্ডার ছিনতাই বা পাহারা বসানোর বিষয়ও নেই। এ সব কাজ দ্রম্নত এগিয়ে যাওয়ায় শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৬০৩টি টেন্ডার ই-জিপিতে আহ্বান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৩৬৯টি চুক্তি সম্পন্ন করা হয়েছে এবং ৬৫ হাজার ৯৫০টি টেন্ডারের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। ই-জিপি চালুর ফলে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের ব্যবসার প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। টেন্ডার ও সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ই-জিপি সিস্টেমে দরদাতাদের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইকনোমিকস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্স বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ আবদুলস্নাহ তার ‘ইফেক্ট অব ইলেকট্রনিক পাবলিক প্রকিউরমেন্ট : এভিডেন্স ফ্রম বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে উলেস্নখ করেন যে, ই-জিপি প্রয়োগের ফলে গতানুগতিক টেন্ডার ব্যবস্থার তুলনায় দরপত্রের চুক্তিমূল্য ও প্রাক্কলিত খরচের আনুপাতিক হার ১০.২৫% থেকে ১১.৮৫% পর্যন্ত কম হয়। অর্থাৎ তৎকালীন মুদ্রামান অনুসারে বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রাইভেট সেক্টরে নতুন ব্যবসার উদ্যোগ শুরু করার দিকেও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আজ থেকে ১২/১৩ বছর আগেও বিভিন্ন দায়িত্বশীল স্থানীয় সরকার যেমন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নতুন কোনো ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া কিংবা নবায়ন করার জন্য নানামুখী হয়রানির শিকার হওয়া লাগত, এসব প্রতিষ্ঠানে এক শ্রেণির দালালদের দৌরাত্ম্য ছিল ভয়াবহ, যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ট্রেড লাইসেন্স সংশ্লিষ্ট কাজ করিয়ে দেওয়ার নাম করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে, প্রায় প্রতিটি স্থানীয় সরকার অফিসেই এসব দালালদের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট ছিল, এসব সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে কেঊ ট্রেড লাইসেন্স এর কাজ করাতে চাইলে হুমকি দামকিসহ নানামুখী ভোগান্তির শিকার হতো ব্যবসায়ীরা। এসব সমস্যা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে এক্সেস টু ইনফর্মেশন (এটুআই) প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালে ই-ট্রেড লাইসেন্স প্রক্রিয়া চালু করা হয়। ফলে যে কেউ এখন ঘরে বসেই যে কোনো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিশদের অধীনে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারে। আগে সামান্য ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে যে পরিমাণ হয়রানির শিকার হওয়া লাগতো এবং যত জায়গায় ঘুষ দেওয়া লাগতো তার কোনোটাই এখন আর হয় না। উদাহরণ স্বরূপ আগে ২৫ হাজার টাকার আর্টিকেল অব মেমোরান্ডাম সংগ্রহ করতে যেখানে ৮৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্তও লাগতো, আজ সেখানে সরকার নির্ধারিত মূল্যেই অতিরিক্ত কোনো প্রকার খরচ ছাড়াই ট্রেড লাইসেন্স, আর্টিকেল অব মেমোরান্ডাম, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, ট্যাক্স ফাইল সবই সংগ্রহ করা যায় অনায়াসেই।

আগে যেখানে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কাছে সম্পূর্ণ সেক্টরটি কুক্ষিগত ছিল, তারা চাইলেই সিন্ডিকেট করে যেভাবে খুশি সেভাবে মার্কেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এখন আর তা সম্ভব না। ব্যবসায়ের এমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে সারাদেশে উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা। নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা থাকায় দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাচ্ছে। ফলশ্রম্নতিতে ই-কমার্স এখন ব্যবসায় নতুন ক্রেজ, এই সেক্টরে প্রতিনিয়ত মানুষের অংশগ্রহণ বেড়ে চলেছে। প্রসঙ্গত, ২০০৮-০৯ সালে বাংলাদেশে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেটের মূল্য যেখানে ছিল ৭৮ হাজার টাকা, বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি এমবিপিএস মাত্র ৩০০ টাকা। এর ফলে সরকারসহ সর্বস্তরের জনগণ অতি সহজেই অনলাইনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছে নিমিষেই। এখন ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিআইএন) ও বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (বিআইএন), ভ্যাট সার্টিফিকেট, ব্যাংক ট্রানজেকশন ইত্যাদি সবই ঘরে বসে অনলাইনেই করা সম্ভব। এছাড়াও দ্রম্নতগতির ইন্টারনেট সুবিধার ফলে ইন্টারন্যশনাল ট্রেডিং, এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কর্মকান্ড অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। এমনকি আগে যেখানে ইম্পোর্ট করা পণ্য পোর্টে আসার পরও চুরি হয়ে যেত, পদে পদে ঘুষ না দিলে টার্মিনাল থেকে পণ্য খালাস করা যেত না- এখন সেখানে মোবাইলের মাধ্যমেই পণ্যের ট্র্যাকিং থেকে শুরু করে রিলিজ লেটার, কাস্টমস সার্টিফিকেট সবই অতি সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এক উদ্ধৃতিতে সমাজে চাকরির প্রতি প্রচলিত মোহকে পাশকাটিয়ে ব্যবসায় ক্ষেত্রে মেধা ও শ্রম দিয়ে দেশ ও দশের উন্নয়নের ব্যাপারেও বিশেষ জোর দেন। ২০১৮ সালে ‘পলিসি ক্যাফে উইথ সজীব ওয়াজেদ: রিডিফাইনিং এমপস্নয়মেন্ট’ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন ‘হাত পেতে চাকরি নয়, নিজ পায়ে দাঁড়ান, নিজ উদ্যোগে কিছু করুন।’ তিনি আরো বলেন, ‘কর্মসংস্থান সম্পর্কে অতীতে চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের নতুন করে ভাবতে হবে। চাকরি করার জন্য নয়, বরং নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে অন্যের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।’

ব্যবসা ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ অর্থাৎ দেশে সরকারি-বেসরকারি খাতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাবাণিজ্যে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করে বর্তমান সরকারের অসামান্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে রাজধানী থেকে শুরু করে মাঠপর্যায় পর্যন্ত ই-গভার্নেন্স প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ফলে বৈশ্বিক যোগাযোগ আরো সহজ হয়েছে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ট্রেডিং ও ব্যবসায়ে বৈচিত্র্যও আসছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে সরকারের দুরদর্শিতা ও সদিচ্ছার কারণে। ইলেক্ট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) চালু করে এবং এর সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে সরকার ব্যবসার ক্ষেত্রে যে সাম্যাবস্থা নিয়ে এসেছে তা সত্যি প্রশংসার দাবিদার। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ, নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ উন্মোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে নতুন নতুন ব্যবসায়ীর সৃষ্টি যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সব থেকে বড় তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সবশেষে একটি প্রশ্ন- ব্যবসাক্ষেত্রে দলমতনির্বিশেষে গণতান্ত্রিক সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার যে সাফল্যের প্রমাণ দিয়েছে তার প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দিলে কি খুব বেশি জাত যাবে?

শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন :সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ