Deprecated: version_compare(): Passing null to parameter #2 ($version2) of type string is deprecated in /home/sheitefm/public_html/wp-content/plugins/elementor/core/experiments/manager.php on line 132
News - Sheikh Mohammad Fauzul - Page 3

বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব: প্রেক্ষাপট, কুশীলব নিরীক্ষণ

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে যতটা জল ঘোলা করা হয় তা বাংলাদেশের সাথে অন্য কোনো দেশের সম্পর্ক নিয়ে আদৌ হয় না। এই জল ঘোলাটা যে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য আর চারপাশে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের বাইরেও আরও অনেক বিষয়ের ইংগিত বহন করে তা খোলাসা করে না বললেও সকলেই বুঝতে পারে। এই সম্পর্ক নিয়ে সত্য, আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ মিথ্যা বা মনগড়া তথ্যের ছড়াছড়িও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দিক বিবেচনা করলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য ও কর্মসূচি থেকে সরকার ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন পক্ষের মতবাদ সহজেই অনুমেয়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার বা সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল/পক্ষের অবস্থান, বক্তব্য বা কর্মকাণ্ড থেকে সহজেই বিশ্লেষণ সম্ভব বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সমীকরণ। ভারতবিরোধী মনোভাব কি আসলেই বাংলাদেশের বৃহৎ স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে নাকি এটি আমাদের অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা বা ভৌগোলিক রাজনীতির আরেকটা দাবার চাল সেটাও গভীরে গিয়ে ভাবার বিষয়।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব প্রচারের অগ্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে নুরুল হক নুর। এখানে বিশ্লেষণের দাবি রাখে এই প্রচার কি আসলে যুক্তিযুক্ত কারণে নুরের দেশের পক্ষে অবস্থান নাকি কূটনৈতিক বিষয়াদি আমলে না নিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সে এই পথ অবলম্বন করেছে। ধর্ষণ মামলার আসামি হিসেবে সে যেহেতু এখনো প্রমাণিত নয় সেহেতু তার ব্যক্তিগত নৈতিকতা বা দেশপ্রেম নিরূপণে আপাতত এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে গ্রহণ করা হচ্ছে না। কিন্তু এককভাবে দেশব্যাপী এই ধরনের একটি ক্যাম্পেইন পরিচালনা, কোনো চাকরি বা ব্যবসা না করেই ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে বসবাস ইত্যাদি স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে ভারতবিদ্বেষী এই প্রচারণায় নুর কুশীলবমাত্র। নুরকে সামনে রেখে এর পেছনে আরেকটি বড় দল বা পক্ষ অর্থায়ন, কর্মসূচি নিরূপণ ও কৌশল প্রণয়নে কাজ করছে সেটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই তা সে পক্ষ ভালোই হোক বা খারাপ। তবে আসিফ নজরুল, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. কামালের মতো ব্যক্তিরা যে সেই বিশেষ পক্ষের সাথে যুক্ত তা প্রমাণিত হয় ধর্ষণ মামলার রায়ের আগেই নুরের পক্ষে তাদের এহেন নির্লজ্জ সমর্থনে। রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে যেকোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে এমন নগ্ন একপাক্ষিক বক্তব্য অসম্ভবই বটে। পেছন থেকে যারা নুরের কাজ করছে তারা আসলে বাংলাদেশের পক্ষে না বিপক্ষে তা সিদ্ধান্তে আসার জন্য সেই পক্ষ কারা এবং তাদের উদ্দেশ্য জানা জরুরি।

আপাত দৃষ্টিতে এই ধরনের অর্থায়ন সম্ভব শুধুমাত্র চীনের পক্ষেই বলে ধারণা করা যায়। একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র মনে করছে, বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বাড়াতে আর্থিক জোগানসহ নানা রকম ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশেরই আরেক বন্ধুপ্রতিম দেশ চীন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাথে চীনের বৈরী সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ এই ধারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ভৌগোলিকভাবেও ভারতকে কোণঠাসা করতে ভারতের সব থেকে কাছের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র থেকে ভারতকে আলাদা করে ফেলা চীনের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ইতোমধ্যে এই ধরনের কৌশল চীন অন্যান্য দেশে সফলভাবেই প্রয়োগ করেছে।

ভেবে দেখার মতো বিষয়, ভারতবিদ্বেষী কার্যক্রমে চীনের এই গোপন অর্থায়ন আমাদের জাতীয় স্বার্থকে ত্বরান্বিত করবে কি? ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি আমাদের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক কোনোভাবে লাভজনক কি না সেটার স্বরূপ নির্ধারণ জরুরি। যদিও বাংলাদেশ সরকার এখনো পর্যন্ত দুই পক্ষের সাথেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুচারুভাবে রক্ষা করে চলেছে। তবে গোপনে অর্থায়ন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপে এই অবস্থার পরিবর্তন হলে তা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর হবে না ।

সামগ্রিক জনমত বিবেচনায় এটি প্রমাণিত হয় ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বাংলাদেশে কোনো জাতীয় দাবি বা জাতীয় ঐক্য নয় বরং কোনো স্বার্থরক্ষায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়ে দেয়া একটি রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের সুচারু ধারা অব্যাহত রাখা এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্তগুলোতে নিজেদের অবস্থান জনগণের কাছে স্পষ্ট করা।

লেখক পরিচিতি: রাজনীতিক ও প্রযুক্তি ব্যবসায়ী

 
 

যুবলীগের নতুন সামাজিক জাগরণ

১৯৭২ সাল। তখনও সদ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির অভাব আর দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সেই অভাব পূরণে সংগ্রামেরত। এমন অবস্থায় সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভÑ জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে সামনে রেখে ক্রমাগত উন্নয়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ যুবকদের নিয়ে একটি নতুন অঙ্গ সংগঠন তৈরি করে। সেই প্রেক্ষিতেই ১৯৭২ সালের ১১ নবেম্বর মুজিববাদকে আদর্শ মেনে নিয়ে জন্ম নেয় আওয়ামী যুবলীগ।

তবে যুবলীগের শুরুর দিকের গল্পটা বলতে হলে একটি নাম উল্লেখ করতেই হবে। তিনি হলেন যুব রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ ফজলুল হক মনি। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল সংগ্রামেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন মনি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনের নিমিত্তে তার নির্দেশে দেশের কল্যাণকামী যুবসমাজকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুবলীগ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি নাম। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ গড়তে গিয়ে যুবলীগ নেতা বগুড়ার আব্দুল খালেক খসরু, চট্টগ্রামের মৌলবি সৈয়দ আহমদ জীবন দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যুবলীগই সর্বাগ্রে নেতৃত্ব দিতে থাকে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত যুবলীগের সক্রিয় কর্মী শহীদ নূর হোসেনের রক্তে অর্জিত হয়েছে এদেশের গণতন্ত্র।

দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যুবলীগের সুনাম, ঐতিহ্য হোঁচট খেয়েছে বারবার। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি- যুবলীগের বিরুদ্ধে জনগণের মনে এইসব অভিযোগই লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।

সর্বশেষ ২০১৮-১৯ সালে গোপন সূত্রের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন বাসায়, অফিসে ও ক্লাবে অভিযান চালিয়ে খুঁজে পায় অসংখ্য অবৈধ ক্যাসিনো। পরবর্তীতে দেখা যায় এই পুরো ক্যাসিনো ব্যবসার পেছনেই জড়িয়ে আছেন সুযোগসন্ধানী ক’জন যুবলীগ নেতা। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একে একে মিলতে থাকে যুবলীগের বিভিন্ন নেতার অবৈধ সম্পদ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির কালো ইতিহাস। যুবলীগ থেকে এদের বহিষ্কার করা হলেও একটি দল হিসেবে যুবলীগের ভাবমূর্তি একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকে এই সময়টায়।

তবে এই পরিমাণ কেলেঙ্কারি ও জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যুবলীগকে পুনরায় প্রাণবন্ত করার চেষ্টা থেকে সরে আসেননি। শুরুতেই আওয়ামী লীগ নতুন নেতৃত্বের হাতে অঙ্গ সংগঠনটির ক্ষমতা ন্যস্ত করে। মেধাবী ও রুচিশীল ব্যক্তিত্ব শেখ ফজলে শামস পরশকে চেয়ারম্যান এবং ক্লিন ইমেজের অধিকারী ও তৃণমূল মানুষের কাছে জনপ্রিয় মাইনুল হোসাইন খান নিখিলকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে। নতুন কমিটির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরপরই তারা একের পর এক নতুন কর্মসূচী হাতে নেয়ার মাধ্যমে অসহায় ও দুস্থ মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে। পরশ-নিখিল যুবলীগের নেতৃত্বে আসার পরপরই সঙ্কট কাটিয়ে যুবলীগের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে নতুন উদ্যমে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে দলটি। যাত্রা শুরু হয় নতুন এক মানবিক যুবলীগের। করোনাকালীন গরিব ও খেটে খাওয়া প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে খাবার দিয়ে এখন অবধি সহায়তা করেছে যুবলীগ। এছাড়াও রমজান মাসজুড়ে অসংখ্য এতিমখানায় ইফতার সরবরাহ করছে সংগঠনটির বিভিন্ন নেতা। মহামারীর সময় বোবা ও বধিরদের সাহায্যেও কাজ করছে যুবলীগ। এখন অবধি দেশের নানা প্রান্তে প্রায় ১০ লাখ মাস্ক বিতরণ করেছে যুবলীগ কর্মীরা।

দলটি তাদের কাজের পরিধি শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যান্ডেট ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির পথে দেশকে এগিয়ে নিতে তারা তাদের সেবাদান করার ইচ্ছাকে নিয়ে গেছে ডিজিটাল দুনিয়াতেও। নবনির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ১০০-এরও অধিক ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে টেলিমেডিসিন দেয়া হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ দেশের কৃষকরা। এই চিন্তাকে বুকে ধারণ করে তাদের সাহায্যেও কাজ করছে যুবলীগ। ধান কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি দিয়ে ফসলের মৌসুমে তাদের সাহায্য করছে যুবলীগের কর্মীরা। এছাড়াও বন্যার্তদের খাদ্য সহায়তা প্রদান, করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের মতো আপাতদৃষ্টিতে সাহসী কাজেও দেখা মিলছে যুবলীগের স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের। এগুলোর বাইরেও মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ‘গাছ লাগাই জীবন বাঁচাই’ স্লোগানকে সামনে রেখে যুবলীগ এখন পর্যন্ত ৩২ লাখের বেশি বৃক্ষরোপণ করেছে, যে কার্যক্রম এখনও চলমান।

এত এত সেবাধর্মী কর্মসূচী দলটির সাংগঠনিক কর্মকা-ের চরিত্রই পাল্টে দিয়েছে। আগে যেসব কর্মী নিয়মিত দলের বড় নেতাদের পিছু পিছু চলত, তোষামোদ করত, নতুন কমিটি আসার পর এই একই কর্মীরা মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটছে বিভিন্ন সাহায্য প্রকল্প নিয়ে। কারণ এটিই এখন যুবলীগের সক্ষমতা। নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রাত-দিন পরিশ্রম করে যেভাবে সেবাধর্মী কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে রেখেছেন, দলের কর্মীদের জন্যও তা চমৎকার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। সেইসঙ্গে দলের বড় নেতাদের মাঠে না নেমে শুধু কর্মীদের অর্ডার দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাও ভেঙ্গে দিয়েছে নতুন কমিটি। তোষামোদ বা উপহার দিয়ে এখন আর কোন কর্মীর পক্ষে পদ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বরং জনকল্যাণে একজন কর্মী কতটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছে সেটাই বর্তমানে পদের সিঁড়ি বাইবার একমাত্র উপায়। দলের ভেতর এরকম একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়ায় সকল নেতা-কর্মীর মাঝেই মানুষের সেবায় কাজ করার ইচ্ছা দিন দিন আরও জোরালো হচ্ছে। ফলে সমাজে দেখা যাচ্ছে পরিবর্তনের এক নতুন হাওয়া।

একটি রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন হিসেবে যুবলীগের নতুন প্রত্যেকটি কর্মসূচী সমাদৃত হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে। সেইসঙ্গে দেশের যুবকরা খুঁজে পাচ্ছে ভাল কাজ করার অনুপ্রেরণা। এই সুস্থ প্রতিযোগিতা দলের স্থায়ী চেতনার অংশ হয়ে দাঁড়ালেই কেবল যুবলীগ দেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিবে ঠিক আগের মতো, যেমনটা স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

 

সরকার-ব্যবসায়ী সমন্বিত উদ্যোগই চাঙা রাখবে অর্থনীতি

করোনার ভয়াল থাবায় প্রায় দেড় বছর ধরে নানামুখী সঙ্কটের সম্মুখীন সমগ্র বিশ্ব। জনজীবন, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, যোগযোগ ব্যবস্থা সবকিছুতেই আমূল পরিবর্তন এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন নানামুখী শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। করোনা মোকাবেলায় একদিকে যেমন বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে অর্থনীতি চাঙা রেখে জীবনমান ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ। করোনার প্রভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সঙ্কট বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। এখনই প্রয়োজনীয় সমন্বিত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সামনে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হবে বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

উন্নতদেশসমূহ অর্থনীতির ভাঙন সামাল দিতে ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। উন্নত দেশসমূহের এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের জনবহুল দেশসমূহে নানা সীমাবদ্ধতা থাকায় শুধু সরকারের পক্ষে করোনাকালীন অর্থনীতি চাঙা রাখাটা অনেক কঠিন। বরং প্রয়োজন দেশের ব্যবসায়ী ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেনি। সেটি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই দেশে করোনা সংক্রমণ ও করোনায় মৃত্যুর সংখ্যায় নতুন রেকর্ড হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠোর লকডাউনের পথে হাঁটছে সরকার। আপাতদৃষ্টিতে গণহারে ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করার আগ পর্যন্ত লকডাউনই উপযুক্ত সমাধান মনে হলেও বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে দেশের অর্থনীতি। ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বের মত চাপের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতিও। প্রসঙ্গত ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রমে অনেক দেশ থেকেই এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংকের বরাতে বলা হচ্ছে, করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই থেকে তিন শতাংশে নেমে যেতে পারে। যেখানে অর্থবছরের শুরুতে আট দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আবার চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে সরকার; যদিও সরকারের এই লক্ষ্য কতটুকু পূরণ হবে তা নির্ভর করছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আরও কত তীব্র হবে তার ওপর। এর পাশাপাশি সরকার এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কি পরিমাণ সমন্বয় সাধন হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে সরকার নির্ধারিত প্রবৃদ্ধি অর্জন কত হবে। 

করোনার চলমান ঢেউ মোকাবেলায় নানা বিধি নিষেধ আরোপ করায় (করোনার প্রকোপ কমাতে এসব বিধিনিষেধ অত্যাবশ্যক) এরই মধ্যে দেশের কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহণ শ্রমিক, রিকশা চালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের কোন কাজ নেই বললেই চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনায় লকডাউনের কারণে প্রতি মাসে অর্থনীতিতে এক লাখ দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। আর কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দেশে ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা৷

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউ বিপদজনক হতে যাচ্ছে, যার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে পাচ্ছি। করোনার প্রথম ধাপে গ্রাম গঞ্জে করোনার প্রকোপ তেমন লক্ষণীয় না হলেও এবার গ্রামে গঞ্জেও করোনা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী বিভাগে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডব ভয় জাগানিয়া। ইতোমধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার সারা দেশে সাত দিনের কঠোর লকডাউনের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যা আরও ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে এরইমধ্যে।

এই লকডাউনের মাঝেও সরকার অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে জরুরি সেবার পাশাপাশি দেশের শিল্পকারখানা চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা একটি যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হচ্ছে। এখন ব্যবসায়ীদের অর্থাৎ শিল্প মালিকদের উচিত নিজেদের ও দেশের স্বার্থে সরকারের যথাযথ নির্দেশনা মেনে নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করা। নিজ নিজ শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা উচিত শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকেই। কর্মস্থলে কেউ যেন করোনা আক্রান্ত না হয় সেবিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এছাড়া সাময়িক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রণোদনা প্রদান করার হচ্ছে, তারও যেন সদ্ব্যবহার হয়- সেদিকে সরকারের বিশেষ নজরদারি থাকা আবশ্যক। অর্থনীতিবিদদের মতে, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে দুই-এক বছরের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ সরকার বড় অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এখন প্রয়োজন সরকার ঘোষিত এসব প্রণোদনা প্যাকেজের যথাযথ সমন্বয় সাধন।

চিরচারিত ব্যবসায়িক শৃঙ্খল বা পদ্ধতি থেকে থেকে বের হয়ে ব্যবসায়ীদের উচিত করোনার প্রভাবকে দীর্ঘমেয়াদি ধরে ব্যবসায় নতুন কার্যকরী পদ্ধতি আরোপ করা। ব্যবসায়ীদেরকে সরকারের প্রণোদনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।নিজেদের ব্যবসায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি করোনাকালে মানুষের চাহিদা বিশ্লেষণ সাপেক্ষে নতুন ব্যবসার ধারণা তৈরি এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ইন্টারনেটের সর্বোত্তম ব্যবহার ঘটিয়ে ব্যবসায় নতুন ধারা সৃষ্টি করা যেতে পারে, আমাদের সবারই জানা, করোনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স সিস্টেম অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর ফলে একদিকে যেমন করোনা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মানা অনেক সহজ হচ্ছে অন্যদিকে তুলনামূলক অনেক কম খরচে ব্যবসায়িক কার্যক্রমও কার্যকর এবং দ্রুততর পদ্ধতিতে চালানো সম্ভব হচ্ছে। এর পাশাপাশি ব্যবসায় ‘হোম অফিস’ ট্রেন্ড চালু করাটাও একটি যুগোপযোগী পদ্ধতি হতে পারে। অর্থাৎ একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যেসব কাজ একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বাড়িতে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারেন সেসব কাজ উক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বাড়িতে রেখেই করানো। সেক্ষেত্রে একদিকে যেমন ব্যবসায়িক অফিসের খরচ কমবে অন্যদিকে করোনার ঝুঁকিও কমে আসবে। তবে সেক্ষেত্রে হোম অফিস করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় লজিষ্টিক সাপোর্ট করাটা বাধ্যতামূলক। প্রসঙ্গত এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক নামী দামী কোম্পানি হোম অফিস নিয়ে এক ধরনের সার্ভে চালাচ্ছে যে, তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনকোন বিভাগের কাজ হোম অফিসের মাধ্যমেই করানো সম্ভব। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে তারা সার্ভের ওপর ভিত্তি করে তাদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য হোম অফিসের ব্যবস্থা করছে। এতে করে কর্মীরা বাড়িতে থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে করোনার ঝুঁকি ছাড়াই তাদের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারছেন। অন্যদিকে ব্যবসায়িক অফিসে জনসমাগম তুলনামূলক কম থাকায় করোনার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাচ্ছে। মানুষ কম থাকায় অফিসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা অনেক সহজ হচ্ছে।

আমরা সবাই জানি যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা নির্ভর করে সেদেশের শিল্প খাত, কৃষি খাত, সেবা খাতের মতো যে সেক্টরসমূহ রয়েছে সেসব খাতের এগিয়ে যাওয়ার ওপর। বলা বাহুল্য যে, দেশের অর্থনৈতিক প্রতিটি খাতই করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  তাই সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে সরকারের পাশাপাশি সকল খাতের সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের প্রতিটি অর্থনৈতিক খাতের ব্যবসায়ীরা যখন বৃহত্তর পরিসরে সরকারের সাথে সমন্বয় সাধন করে তাদের খাতগুলোকে এগিয়ে নিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে তবেই একমাত্র করোনাকালীন অর্থনৈতিক  সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আমরা সৌভাগ্যবান যে, দেশে বর্তমানে একটি ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত করে যাচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সবসময় ব্যবসায়ীদের সুবিধা অসুবিধা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন, যার প্রতিফলন এবারের ঘোষিত বাজেটেও লক্ষণীয় হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে- বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা; কভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সফল বাস্তবায়ন; কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া; অধিক খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সেচ ও বীজ প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন, সারে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা; ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ; সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ; গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ (মুজিববর্ষের প্রধান কার্যক্রম) কার্যক্রম বাস্তবায়ন; নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা চালু রাখা এবং শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এবারের বাজেটেও সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় দেশের অর্থনৈতিক খাতগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন সরকারের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসা।  তবেই অর্থনীতি বৈশ্বিক মানচিত্রে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।

 

যুবলীগের ভালো কাজে বাহবা দিতে বাধা কোথায়?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুবলীগ বরাবরই একটি বড় নাম। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে মুজিববাদ আদর্শকে পুঁজি করে যুব রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ ফজলুল হক মনির হাত ধরে যাত্রা শুরু হওয়া এই সংগঠনটির দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রাম ইতিহাসের অলি-গলি কম দেখা হয়নি। দেশের মাটিতে গণতন্ত্রের চড়াই-উতরাইয়ের পুরোটা সংগ্রামেই যুবলীগের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কিন্তু সংগঠন হিসেবে যুবলীগের ইমেজের কথা ভাবলে, সবার চোখের সামনে একদম ধবধবে সাদা পর্দা ভেসে ওঠে না। কিছু সুযোগসন্ধানী ও বিপথগামী নেতাকর্মী বিভিন্ন সময় নিজ স্বার্থ হাসিল করার জন্য যুবলীগের ইমেজ যে নষ্ট করেছে তা অস্বীকার করবারও কোনো সুযোগ নেই। তবে যুবলীগের একজন তৃণমূল পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মীর নেতিবাচক কর্মকান্ডের জন্য যুবলীগকে যে পরিমাণ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় অন্যদিকে প্রতিনিয়ত যুবলীগের মাধ্যমে যে ভালো কাজগুলো হচ্ছে সেসব নিয়ে তেমন কোনো উৎসাহ কিংবা প্রশংসামূলক আলোচনা চোখে পড়ে না সচরাচর।

সাধারণ মানুষতো দূরে থাক আওয়ামী লীগ তথা যুবলীগের অনেক নেতাকর্মীই জানে না যে ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম যে দুব্যক্তি জীবন দিয়েছিলেন তারা ছিলেন বগুড়ার যুবলীগ নেতা আব্দুল খালেক খসরু এবং চট্টগ্রামের মৌলভি সৈয়দ আহমদ। এরশাদবিরোধী আন্দোলন ঠিক যেই মুহূর্তে একটি গণআন্দোলনে পরিণত হলো, সেই মুহূর্তটিও কিন্তু এক যুবলীগ কর্মীরই আত্মত্যাগে রঞ্জিত। শহীদ নূর হোসেন, যাকে আমরা সবাই চিনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে, তিনি যে যুবলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন এই তথ্যটি ক’জনেরই বা জানা আছে? আর জানা নেই বলেই, যুবলীগের ইমেজ চিন্তা করলে এই সংগ্রামী আত্মত্যাগগুলো মানুষের মন এড়িয়ে যায়।

২০১৯ সালে ক্যাসিনো কান্ডে যুবলীগের ইমেজ কিছুটা হোঁচট খেলে তা পুনরুদ্ধারে সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে এবং ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে মেধাবী ও রুচিশীল ব্যক্তিত্ব শেখ ফজলে শামস পরশকে চেয়ারম্যান এবং ক্লিন ইমেজের অধিকারী ও তৃণমূল মানুষের কাছে জনপ্রিয় আলহাজ মো. মাইনুল হোসাইন খান নিখিলকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে।

নতুন কমিটির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরপরই যুবলীগ সারাদেশে একের পর এক নতুন কর্মসূচি হাতে নেওয়ার মাধ্যমে অসহায় ও দুস্থ মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে। পরশ-নিখিল যুবলীগের নেতৃত্বে আসার পরপরই সংকট কাটিয়ে যুবলীগের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে নতুন উদ্যমে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে দলটি। যাত্রা শুরু হয় নতুন এক মানবিক যুবলীগের। করোনাকালীন গরিব ও খেটে খাওয়া প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে খাবার দিয়ে এখন অবধি সহায়তা করেছে যুবলীগ। এছাড়াও রমজান মাসজুড়ে অসংখ্য এতিমখানায় ইফতার সরবরাহ করেছে সংগঠনটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী। মহামারির সময় বোবা ও বধিরদের সাহায্যেও কাজ করছে যুবলীগ। এখন অবধি দেশের নানা প্রান্তে প্রায় ১০ লাখ মাস্ক বিতরণ করেছে যুবলীগ কর্মীরা।

অথচ, যুবলীগের বৃহৎ পরিসরে পরিচালিত এমন মানবিক কর্মকান্ডের খবর হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নিজস্ব প্রোফাইল বাদে বেশির ভাগ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় আসেনি বললেই চলে। অথচ যুবলীগের যে কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী কোনো অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকলে তা নিয়ে দেশের মিডিয়া, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমালোচনায় সয়লাব হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার তৎকালীন ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে রাতের আঁধারে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। ঘটনা ঘটার পরপরই অভিযোগের তীর ছোড়া হয় স্থানীয় দুই যুবলীগ নেতার দিকে, খুব স্বাভাবিক ও অযাচিতভাবে সমালোচনায় বিদ্ধ হয় পুরো যুবলীগ। অথচ ঘটনার কিছু দিন পর অধিকতর তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসে যে, কোনো যুবলীগ নেতা নয়, ওই ন্যক্ক্যারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে ইউএনওর সরকারি বাসায় মালির দায়িত্বে থাকা তার ব্যক্তিগত কর্মচারী। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের পূর্বেই যুবলীগের ইমেজকে যে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো সমালোচনাকারীরা এর কোনো দায় নেয়নি। এরকমভাবেই বিভিন্ন ইসু্যতে ঘটনা যতটুক নেতিবাচক তার থেকে অনেক রঙ লাগিয়ে বারবার জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই সংগঠন হিসেবে যুবলীগের ঘুরে দাঁড়াবার যে চেষ্টা ও পরিশ্রম তা বরাবরই থেকে গেছে উপেক্ষিত। ডেইলি স্টার, প্রথম আলোতে কাজ করা সাংবাদিকরা নিজদের সৎ ও নিরেপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে দাবি করলেও যুবলীগ ইসু্যতে বরাবরই একপেশে নেতিবাচক রিপোর্ট করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তারা। যুবলীগের ইতিবাচক মানবিক কর্মকান্ড কখনোই তাদের সংবাদের শিরোনাম হতে পারেনি।

তাই বলে কিন্তু কর্মীরা একদমই থেমে থাকেনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যান্ডেট ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির পথে দেশকে এগিয়ে নিতে তারা তাদের সেবাদান করার ইচ্ছাকে নিয়ে গেছে ডিজিটাল দুনিয়াতেও। নবনির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ১০০-এরও অধিক ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে টেলিমেডিসিন দেয়া হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ দেশের কৃষকরা। এই চিন্তাকে বুকে ধারণ করে তাদের সাহায্যেও কাজ করছে যুবলীগ। ধানকাটা, ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে ফসলের মৌসুমে তাদের সাহায্য করছে যুবলীগের কর্মীরা। এছাড়াও বন্যার্তদের খাদ্য সহায়তা প্রদান, করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের মতো আপাতদৃষ্টিতে সাহসী কাজেও দেখা মিলেছে যুবলীগের স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের। বলা বাহুল্য যে, কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিমিত্তে এসব মানবিক কার্যক্রম কোনো প্রকার আর্থিক সুবিধা ছাড়াই করে যাচ্ছে সর্বস্তরের যুবলীগ নেতাকর্মীরা।

অথচ, উলিস্নখিত এসব কর্মকান্ড যদি কোনো সাধারণ এনজিও বা মানবকল্যাণে নিয়োজিত সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান করত করোনাকালীন সময়ে, কিংবা এর সিকিভাগও যারা ইতোমধ্যে করেছে তাদের সামাজিক ও গণমাধ্যমে মানুষ যেভাবে সাদরে গ্রহণ করেছে, প্রশংসা বিলিয়েছে; যুবলীগের ভাগ্যে তার একবিন্দুও জোটেনি। অথচ এমন না যে এই প্রশংসাটুকু যুবলীগের প্রাপ্য নয়। কিন্তু মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোনো জায়গা থেকেই তেমন কোনো প্রশংসা পাননি নেতাকর্মীরা। এত সব রুচিশীল সেবাধর্মী কর্মকান্ডের পরও বারবার যুবলীগের বিভিন্ন নেতিবাচক ইসু্যকেই শুধু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে সবার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে সংগঠনটিকে।

তবে, যুবলীগ কর্মীরা কিন্তু তাই বলে এই বাহবা পাওয়ার অপেক্ষায় বসে নেই। এত এত নতুন কর্মসূচির ভিড়ে তাদের এখন বসে থাকার জো নেই। আগে যেসব কর্মী নিয়মিত দলের বড় নেতাদের পিছু পিছু তোষামোদ করতে সময় ব্যয় করত, এখন তারাই মানুষের বাড়ি বাড়ি ছুটছে বিভিন্ন সাহায্য প্রকল্প নিয়ে। কারণ এটিই এখন যুবলীগের সক্ষমতা। বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রাত-দিন পরিশ্রম করে যেভাবে সেবাধর্মী কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে রেখেছেন, দলের কর্মীদের জন্যও তা সৃষ্টি করেছে চমৎকার দৃষ্টান্ত। সেই সঙ্গে দলের বড় নেতাদের মাঠে না নেমে শুধু কর্মীদের অর্ডার দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাও ভেঙে দিয়েছে পরশ-নিখিলের ডায়নামিক নেতৃত্ব।

এই সুস্থ প্রতিযোগিতা দলের স্থায়ী চেতনার অংশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিন দিন। সেই সঙ্গে বাড়ছে সংগঠনের সক্ষমতা; কর্মীদের মধ্যে যা সঞ্চার করেছে পরিবর্তনের নতুন হাওয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যুবলীগ জায়গা করে নিচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি মানুষের মনে।

শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

 

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দলিল

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে স্বাধীনতার সিঁড়ির অন্যতম মই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ছয় দফা নামক ঐতিহাসিক সিঁড়ি বেয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। জাতির পিতার ছয় দফায় স্বাধীন বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির যে স্বপ্ন লুক্কায়িত ছিল স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে সেসব স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে আজকের বাংলাদেশ।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন। পরবর্তীতে এই ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপান্তর হতে থাকে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগের ডাকে পূর্ব বাংলায় হরতাল চলাকালে পাকিস্তানী পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালায়। এতে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালী শহীদ হন। প্রায় আট শ’ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মী এবং হাজারো আন্দোলনরত সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়।

ছয় দফার গুরুত্বটা অনুধাবন করতে হলে শুরুতেই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে ছয় দফার প্রয়োজন কেন হলো সেই পটভূমি নিয়েও একটু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা আদায়ের সংগ্রাম বাঙালীর মুখের ভাষার অধিকার তো নিশ্চিত করেছেই, এর পাশাপাশি চিরতরে এদেশের মানুষের মনে একটি বার্তা গেঁথে দিয়েছে যে, ‘তুমি এখনও স্বাধীন নও’। আর ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই স্বাধীনতার জন্য তৃষিত বাঙালীদের সংগ্রামের শুরু। ভাষা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা শেখ মুজিবুর রহমান সব সময়ই একটি সার্বভৌম বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন। আর সেই স্বপ্নকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসতে তাঁর সহনেতাকর্মীদের মধ্যেও এই চেতনা সঞ্চার করেছেন। সেই ফলশ্রুতিতেই ১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে লাহোর পৌঁছান। পরদিন সাবজেক্ট কমিটির সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয় দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলনের আলোচ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানী পত্রপত্রিকায় ছয় দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। ফলে শেখ মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। বাঙালীদের একটি আলাদা সার্বভৌম ও স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার শুরু এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। ছয় দফায় প্রস্তাবিত দাবিগুলোর দিকে নজর দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে পাঠকদের জন্য।

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে।

২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়- প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক। অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সংবলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে।

৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোন হারে আদায় করা হবে।

৫. দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোন শুল্ক ধার্য করা হবে না। রাজ্যগুলো যাতে যে কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।

৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।

এই দূরদর্শী ছয়টি দফার প্রত্যেকটিই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মাপকাঠিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সমকক্ষ করে তোলার একেকটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক এই তিন ক্ষেত্রে নিজ ভূখ-ের অভ্যন্তরে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়াই একটি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার প্রথম নিশানা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রতিটি দফাই এমনভাবে নক্সা করেছেন, যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ক্রমশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে স্বনির্ভর একটি নতুন রাষ্ট্রে পরিণত করে। অর্থাৎ বাঙালী জাতিকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর সব সময়ের মূল ভাবনা। ছয় দফার প্রথম দুটি দাবি পুরোপুরিই রাজনৈতিক। লাহোর প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, “ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাসমূহের মতো যেসব অঞ্চলে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব অঞ্চলে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (স্টেট বা প্রদেশ) গঠন করতে হবে, যার মধ্যে গঠনকারী এককগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।” অর্থাৎ এর পুনরাবৃত্তি নিশ্চিতকরণের দাবি উঠানো মানেই হচ্ছে বাঙালীরা নিজেদের ভূখ-ে নিজেদের ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের মূল রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাইছে।

দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবন্ধু আবারও নিশ্চিত করেছেন যে, লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে যেন বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যতীত আর কোন ক্ষমতা না থাকে। এটি মূলত তৎকালীন পাকিস্তানকে ক্রমশ সামরিক শাসনের বলয় থেকে বের করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দিকে আনয়নের একটি উদ্দেশ্য। জনগণের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস ন্যস্ত করার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান যে সেই শুরু থেকেই বদ্ধপরিকর ছিলেন তা এই দুই দাবিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অর্থনৈতিকভাবে পূর্বপাকিস্তান নিগৃহীত হয়ে আসছে ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর থেকেই। ধান, মসলা, চিনির মতো দেশের অভ্যন্তরের খাদ্য চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ফসল তো এই ভূখন্ডে প্রচুর হতোই, সেইসঙ্গে পাটের মতো অর্থকরী রফতানিযোগ্য পণ্যের মূল উৎপাদনস্থলও ছিল এই বাংলা। কিন্তু জাতীয় বাজেটে কখনই এই অবদানের বিনিময়ে কিছু পায়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। বিভিন্ন অর্থবছরে খাদ্য ঘাটতিও ছিল নিত্যদিনকার সমস্যা। তাই জনমনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাহিদা ছিল শুরু থেকেই। আর বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দাবি বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে আরও স্বনির্ভর করার চেতনা থেকেই উৎপত্তি। তিনি এখানে দুটি আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। তা সম্ভব না হলে বলেছেন, আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক তৈরি করতে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাজ্য যেন নিজের আয় নিজের রিজার্ভে রাখতে পারে সেই দাবি তোলেন তিনি। অর্থাৎ, কোনভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের হাতে যেন বাংলার মানুষের পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সম্পদ পাচার হতে না পারে। তা এই তিনটি দাবির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তিনি। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের দূরদর্শী স্বপ্ন তিনি তখন থেকেই দেখতেন।

সবশেষের দফায় তিনি সরাসরি সামরিক সার্বভৌমত্ব দাবি করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীগুলোতে বাঙালী অফিসারদের পদোন্নতি দেয়া হতো না। বড় বড় মূল পদগুলোর একটিও পশ্চিম পাকিস্তানী ছাড়া অন্য কাউকে দেয়ার রেওয়াজই ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথমবারের মতো রাজ্য সরকারের হাতে অস্ত্র কারখানা তৈরি, নিজস্ব সামরিক বাহিনী প্রস্তুতকরণ প্রভৃতি বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার দাবি করেন এই দফায়।

সর্বোপরি ছয় দফাকে শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালী স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রথম ড্রাফট হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়। কেননা, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীতে একের পর এক যা ঘটেছে ইতিহাসের পাতায় তাই বাংলাদেশকে স্বাধীন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। অন্যভাবে বললে বাঙালীও বঙ্গবন্ধুর মূল স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে।

একটা গল্প দিয়ে শেষ করা যাক।

ছয় দফা ঘোষণার পর তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং ন্যাপের প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,

-আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?

আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব,

-আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।

এই এক দফার ফলাফলই আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

 

 

 

 
 
 
 

 

গণতন্ত্রের ফিনিক্স পাখির নীড়ে ফেরার দিন

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে বিএনপি-জামায়াত সরকার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পরবর্তী সময়ে সাংবিধানিক নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যার নিমিত্তে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় চেপে বসে ক্ষমতালিপ্সু কতিপয় কুশীলব। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্মূলের নীলনকশা। তাদের এ দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এদেশের রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে শুরু হয় বিশেষ পরিকল্পনা। ২০০৭ সালে মমতাময়ী নেত্রী অসুস্থ পুত্রবধূ ও মেয়েকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে গেলে তাকে দেশে ফিরতে বাধা দেয় তৎকালীন অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাদের এ ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে মাতৃভূমিতে ফিরে আসার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা।

এর আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরতে এক অবৈধ নিষেধাজ্ঞা জারি করে তৎকালীন সরকার। জারিকৃত বেআইনি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দেশব্যাপী। বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐকান্তিক দৃঢ়তা, সাহস ও গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়। অতঃপর শুরু হয় এক ব্যাকুল প্রতীক্ষা। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আজ থেকে ১৪ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৭ সালের ৭ মে শত প্রতিকূলতা ও গণতন্ত্র হত্যাচেষ্টার কুশীলবদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ লাখো জনতা তাদের হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে দিয়ে সাদরে বরণ করে নেয় তাদের প্রিয় নেত্রীকে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে নির্মূলের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাকে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করে। ২০০৮ সালের ১১ জুন প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কারাবন্দি থাকলেও গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে কোনো আপস করেননি। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও এদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের অধিকার আদায়ে ছিলেন অবিচল। কারণ তিনি জাতির পিতার কন্যা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্টম্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত তার ধমনীতে। দেশব্যাপী নেতাকর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে শেখ হাসিনাকে প্যারোলে মুক্তি দিতে বাধ্য ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকার। প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমন এবং চিকিৎসা শেষে ৪ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। অতঃপর তার সাহসী, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়। আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ম্যান্ডেট নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।

এর পর দেশরত্ন শেখ হাসিনা টানা তিনবারের মতো এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এক যুগ আগে ঘোষিত রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প আজ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকায় রাষ্ট্রের সব বিভাগেই পরিকল্পিত ও কার্যকরী উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি সুফল ভোগ করছে দেশবাসী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার অন্যতম অর্জন যথাযথ প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা। এর পাশাপাশি ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্যও শেষের পথে। সেই সঙ্গে একজন বলিষ্ঠ নারী নেতৃত্ব হিসেবে নিয়মিত সম্মানিত হয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন ফোর্বস ২০২০ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ৩৯তম স্থানে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সংকট নিরসনে রোহিঙ্গা প্রেক্ষাপটে তার ভূমিকা এতটাই প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক দরবারে, যা তাকে এনে দিয়েছে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব। এ ছাড়াও তিনি জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ অর্জন করেছেন। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে নিজ অর্থে গড়ে তুলেছেন পদ্মা সেতু, যা এখন দেশবাসীর সামনে দৃশ্যমান। মহামারি করোনায় পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্র যেখানে ভীষণভাবে ভুগছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় বাংলাদেশ তা যথাযথভাবে মোকাবিলা করে চলেছে।

ফিরে আসার গল্প শেখ হাসিনার জন্য নতুন নয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করা অবৈধ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শত বাধা-বিপত্তি, হুমকি উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন তিনি। এ দেশের মাটির গন্ধ, বাতাসের সংস্পর্শ ও মানুষের ভালোবাসায় হারানো সব খুঁজে নিতে তিনি বারবার ফিরে এসেছেন আমাদের মাঝে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ইতিহাস বিনির্মাণের একটি সূচনাক্ষণ হিসেবে ২০০৭ সালের ৭ মে দিনটি লিপিবদ্ধ হয়ে আছে ও থাকবে।

 

স্মরণ: এম এ ওয়াজেদ মিয়া শ্রদ্ধাবরেষু

প্রথিতযশা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশের রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপিত হবে। তার স্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আজ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বিশ্বমাঝে বাংলাদেশ বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার নিরলস পরিশ্রম অব্যাহত রেখেছিলেন আমৃত্যু।

বর্ণাঢ্য শিক্ষা ও কর্মময় জীবনের অধিকারী ড. ওয়াজেদ মিয়া তার সমগ্র জীবনে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ক্ষমতার অনেক কাছাকাছি থেকেও কখনও ক্ষমতার দাপট না দেখিয়ে বরং খুব সাদামাটা একটা জীবন কাটাতেই পছন্দ করতেন।

১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ড. ওয়াজেদ মিয়া। তার বাবা আব্দুল কাদের মিয়া এবং মাতা ময়েজুন্নেসা। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তিনি চককরিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। এরপর মানসম্মত লেখাপড়ার জন্য তাকে রংপুর জিলা স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকেই তিনি ডিস্টিংশনসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।

১৯৫৬ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর ১৯৫৮ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান এবং ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার সময় থেকেই ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট হতে শুরু করেন রাজনীতির সঙ্গে। ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদশের্র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যোগদান করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগে।

১৯৬১-৬২ শিক্ষা বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬২ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে এবং ওই বছরেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন।

কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে আণবিক শক্তি কমিশনে চাকরিতে যোগ দেন। তারপর ১৯৬৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া।

প্রথিতযশা এই পরমাণু বিজ্ঞানী কর্মজীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাকর্ম করে। ১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাকে অ্যাসোসিয়েটশিপ প্রদান করে।

এ সুবাদে তিনি ১৯৬৯, ১৯৭৩ ও ১৯৮৩ সালে ওই গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবার ছয় মাস গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ইতালির ট্রিয়েস্টস্থ আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ কেন্দ্রে ছয় মাস গবেষণাকর্ম শেষে ১৯৭৪ সালের ১ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ তার ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুলকে নিয়ে জার্মানি ঘুরতে যান। সেই সময়ই দেশের মাটিতে সংঘটিত হয় ইতিহাসের বর্বরোচিত এক হত্যাযজ্ঞ। ওই বছর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তারপর ওয়াজেদ মিয়া পরিবারসহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন।

১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তির দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।

পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থবিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৯ সালে দুই বছর মেয়াদের জন্য একই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পর পর দুই মেয়াদের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পর পর দুটি মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৯১-৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘেরও সভাপতি নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৮৯ থেকে ’৯৩ সাল পর্যন্ত পর পর তিন মেয়াদের জন্য তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

২০০৯ সালের ৯ মে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী তুখোড় মেধাবী এই মানুষটি।

বিজ্ঞান নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন ওয়াজেদ মিয়া। প্রথিতযশা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশের রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হবে। তার স্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আজ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বিশ্বমাঝে বাংলাদেশ বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার নিরলস পরিশ্রম অব্যাহত রেখেছিলেন আমৃত্যু।

ড. ওয়াজেদ মিয়ার ক্ষমতার মোহ না থাকলেও তিনি রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না। স্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সকল বাধাবিপত্তি জয় করে দেশে ফিরতে চাইলে তাতে সমর্থন ও পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন স্বামী ওয়াজেদ মিয়া।

১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেও কর্মসূত্রে আরও কবছর ভারতে থেকে যেতে হয়েছিল ওয়াজেদ মিয়াকে। তবে ভারতে থেকেও প্রতিনিয়ত স্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাকে রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে পরমার্শ দিয়েছেন। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর স্ত্রী শেখ হাসিনা ও আরেক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানাকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়েছেন মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য।

নিজের দুই সন্তান যথাক্রমে সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে আদর্শ শিক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। যার প্রমাণ এরই মধ্যে আমরা পাচ্ছি। পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্নের আলোতে আলোকিত হচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশ। আর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সমাজের অবহেলিত প্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে কাজ করে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

পরিশেষে ড. ওয়াজেদ মিয়া ব্যক্তিজীবনে যেমন একজন সফল ও আদর্শ মানুষ ছিলেন ঠিক তেমনিভাবে স্বামী এবং পিতা হিসেবে তিনি সফল ও বলতে হবে গর্বিত ছিলেন। একজন মানুষ হিসেবে তার বরেণ্য কর্মকাণ্ড ও নির্মোহ জীবনযাপন জাতির কাছে তাকে করেছে অমর।

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

 

যুব রাজনীতির স্থপতি শেখ ফজলুল হক মনি

‘সেই একটা সময় ছিল ত্যাগ-ব্রতের রাজনীতি, তাদের ঘিরে যারা জড়ো হতেন তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছিল। রাজনীতি চর্চার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ ছিল, চরিত্রে সংহতি ছিল। তারা দেশের মানুষকে ভোটার বা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়িই শুধু ভাবতেন না, বড় করে দেখতেন। আমাদের মনি সাহেব ছিলেন এই দলের মানুষ। মনি ভাইকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম।’ কবি আসাদ চৌধুরীর এমন ভাবনার মাঝেই শেখ ফজলুল হক মনির ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের দর্শন ফুটে উঠেছে।

শেখ ফজলুল হক মনি, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি নাম, একটি ইতিহাস। যার হাত ধরে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যুব রাজনীতির বীজ রোপিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালনের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশের কল্যাণকামী যুবসমাজকে সাথে নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নেতৃত্ব গুণাবলী, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এদেশের যুব সমাজের আইকন। যিনি নিজ মেধায় হয়ে উঠেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশের যুব রাজনীতি ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নক্ষত্র, বহুগুণে গুণান্বিত এবং বিরল প্রতিভার অধিকারী শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম শেখ নূরুল হক বঙ্গবন্ধুর নিকটতম আত্মীয় এবং ভগ্নিপতি। মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডে বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর রাখায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বোন আছিয়া বেগমের কাছ থেকে শেখ মনিকে চেয়ে নেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর হাতেই রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের হাতেখড়ি হয় শেখ মনির।

১৯৬০-৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় তৎকালীন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের জোরালো আন্দোলনে বলিষ্ঠ হাতে নেতৃত্ব দেন শেখ মনি। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেয়া শরীফ কমিশনের অগণতান্ত্রিক ও শিক্ষার্থী স্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন।

 

 

শেখ ফজলুল হক মনি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই অসীম সাহসী ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। আর একারণেই ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ফলশ্রুতিতে মোনায়েম খান ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেন। পরে সুপ্রিমকোর্টের রায়ে তিনি তার অর্জিত ডিগ্রি ফিরে পান।

শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব বাংলার মুক্তির সনদ তথা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা পালন করা। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে সারাদেশ ব্যাপী হরতাল সফল করে তোলার অগ্রসেনানী ছিলেন শেখ মনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ওই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম হয়তো পিছিয়ে যেত। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে এ অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। এসময় বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ কারাবাস শেষে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান।

দেশ এবং দলের প্রয়োজনে যেকোনো ধরণের ত্যাগ স্বীকারের মূর্ত প্রতীক ছিলেন শেখ মনি। যার প্রমাণ মেলে ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের সময়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে এমপি হওয়ার সকল ধরণের সুযোগ এবং সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তিনি দেশব্যাপী বৃহত্তর পরিসরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কর্মসূচি প্রণয়নের লক্ষ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন।

 

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক- বীমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ শতাংশ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শেখ মনি।

৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে দেহ মাতৃকার টানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন শেখ মনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের লক্ষ্যে দেশের মুক্তিকামী যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন মুজিব বাহিনী। তিনি ছিলেন উক্ত মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক।
শেখ ফজলুল হক মনি শুধুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, মনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল দার্শনিক, একজন প্রথিতযশা লেখক ও সাংবাদিক। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। শেখ মনি ছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। শেখ মনির লেখা ‘অবাঞ্ছিতা’উপন্যাস পাঠক সমাজেও প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক।
রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখে স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন শেখ মনি। এর প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধু কতৃক ১৯৭৫-এ জাতীয় ঐক্যের রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠনের পর শেখ ফজলুল হক মণি বাকশালের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে।

৭৫ এর ঘাতকরা খুব ভালোভাবেই তা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলো বলেই ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার লক্ষ্যে পরিচালিত আক্রমণের প্রথম শিকার হন শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্বা স্ত্রী আরজু মনি। ঘাতকরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো শেখ মনি বেঁচে থাকলে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।

যতদিন পৃথিবীর আকাশে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়বে ততোদিন এদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলার যুব রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ ফজলুল হক মনি। ব্যক্তি শেখ মনির মৃত্যু হলেও শেখ মনির স্বপ্নের যুবলীগ ও তাঁর আদর্শ চির অম্লান।

বর্তমান যুবলীগের নেতৃত্বে থাকা শেখ মনির সুযোগ্য সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রতিচ্ছবি মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ শেখ মনির আদর্শ লালন করে তাঁর স্বপ্নের “অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ” বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

 

লেখক -শেখ মোহাম্মদ ফাউজুল মুবিন